সচিবালয়ে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই শীর্ষ ব্যক্তি নিয়মিত তাঁর দপ্তরে যান না। এই মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব অবশ্য যৌক্তিক কারণে দপ্তরে অনুপস্থিত। একজন করোনায় আক্রান্ত, অপরজনের স্ত্রী করোনায় মৃত্যুর পর আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন অবস্থায়) রয়েছেন। আর মন্ত্রী তিনি আছেন, আবার নেই। মাঝেমধ্যে দেখা যায় টেলিভিশন বা অনলাইন সংবাদে। আবার চলে যান অফলাইনে। কখনো কোভিড হাসপাতাল উদ্বোধন করেন, কখনো চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে যান বিদেশি প্রতিনিধিদলকে বিদায় জানাতে। তবে কর্মস্থলে শেষ কবে গিয়েছিলেন, তা চট করে বলতে পারেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তিনি হলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
অফিস চলাকালে গত রবি, সোম ও বুধবার—তিন দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘুরে তেমন কোনো কর্মতৎপরতা দেখা যায়নি। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর থাকত এই মন্ত্রণালয়। এখন সেখানে গুটিকয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, লিফটম্যান ছাড়া কাউকে চোখে পড়ে না। দেখা পাওয়া যায়নি মন্ত্রীর একান্ত সচিব কামরুল হাসানকেও। গত সোমবার কথা বলে জানা যায়, অসুস্থ বাবাকে দেখতে তিনি বরিশালে গেছেন। তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মাইদুল ইসলামকে গতকাল ফোন করে জানা যায়, তিনি অসুস্থ, বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছেন।
গত ২৫ মে ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের ছুটির পর থেকেই মন্ত্রণালয়ে অনিয়মিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী। একরকম সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গুঞ্জন আছে, বিতর্ক এড়াতে ও ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি চুপচাপ আছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তৎপরতা দৃশ্যমান নয় কেন, তা জানতে নানাভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁর একান্ত সচিব, জনসংযোগ কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত সহকারীসবার সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করার পর একজন বলেছেন, ‘স্যার বলেছেন, তিনি ব্যস্ত। এখন কথা বলতে পারবেন না।’ গতকাল বুধবারও মন্ত্রী সচিবালয়ে যাননি। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর নম্বরে ফোন করলে একজন ফোন ধরেন। তিনি অফিস সহকারী তোফাজ্জল হোসেন পরিচয় দিয়ে বলেন, মন্ত্রী, সচিব, পিএস, পিআরও কেউ আসেননি। মন্ত্রণালয় খালি। অনেকেই অসুস্থ। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী আসেন না। আমরা সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিই। তিনি জুমের মাধ্যমে বৈঠক করেন।’
গতকাল বিকেলে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী ফারুক আহমেদের সঙ্গে আবারও ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মন্ত্রী সচিবালয়ে যাননি। বাসায় মিটিং করছেন। গতকাল আবারও মন্ত্রীকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যখন সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সক্রিয় এবং প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর মতো ক্ষতির জন্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দায়ী করেছে।
চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, চিকিৎসকদের অনেকেরই অভিযোগ, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে না। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কমান্ডারের মতো সামনে থাকা উচিত ছিল। তাহলে পেছনের লোকজন কাজ করার শক্তি পেতেন। কিন্তু যখন দেখা যায় কমান্ডারের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই, তখন মাঠের কর্মীদের বিশ্বাসের জায়গায় চিড় ধরে।
একাধিক চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি সপ্তাহে তিন দিনও অফিসে যেতেন, তাহলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসকনেতা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আলোচনা করে অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। আগে অনলাইনে বৈঠক হলেও এখন সেটাও হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রীকে কোনো চিঠি পাঠালে তার জবাবও মেলে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন আঞ্চলিক উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। মন্ত্রণালয় এই রোগের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুরু থেকেই করোনা প্রতিরোধে পরিকল্পনার অভাব ছিল। প্রকট ছিল সমন্বয়হীনতা।
বিগত সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয় নিয়ে সরকারের ভেতরে ও বাইরে আলোচনা ওঠে। সরকারি দলের একাধিক নেতার মতে, এই সংকটের সময় তাঁকে সরিয়ে দিলে সরকারের জন্য তা বিব্রতকর হতে পারে ভেবেই তা করা হয়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা শুধু সরকারি দলের বাইরে থেকে হচ্ছে, তা নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী সম্প্রতি ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কে চালাচ্ছে? আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটা একটা আজগুবি বিভাগ বা মন্ত্রণালয়। এই বিভাগের কোনো আগা নেই, মাথা নেই।’ জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনেও বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির একাধিক সাংসদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২৪ ঘণ্টা কাজ করা উচিত। যেমন মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা সার্বক্ষণিক কাজে থাকছেন। সমস্যা বা অসুস্থতা থাকলে বাসায় ছুটিতে থাকতে পারেন, সেটা সাময়িক। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে সর্বনিম্ন পদের কর্মকর্তাকে সারাক্ষণ তাঁর ডেস্কে থাকতে হবে। এই সময় ঘরে বসে নথি সই বা বৈঠক করলে তা তেমন কার্যকর হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্মুখসারির যোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করছে, এটা তাঁদের বুঝতে হবে।