১২ জুন ২০২৩, এইচআরডব্লিউর ওয়েবপোর্টালের একটি বিবৃতি দেশের সচেতন মানুষকে যারপরনাই বিস্মিত করেছে। বিবৃতিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যাঁ পিয়েরে ল্যাক্রোর প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়েছে; কিন্তু বিগত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুনামের কারণেই বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। সশস্ত্র বাহিনী থেকে আজ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৮ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হয়েছেন।
শান্তি রক্ষায় কাজ করার সময় নিহত হয়েছেন ১৩৯ জন, আহত হয়েছেন ২৪০ জন। ২০২২ সালে এসে আমরা সশস্ত্র বাহিনী থেকে ৬ হাজার ৩২৪ সদস্যকে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত দেখতে পাচ্ছি। এর ভেতর নারী সদস্য রয়েছেন ৩৭১ জন। বর্তমানে ৯টি মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্য কাজ করছেন। উল্লেখ্য, সশস্ত্র বাহিনী থেকে ৪৩টি দেশে এ পর্যন্ত শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এমন সাফল্যের গল্পগাথা যে দেশের, সে দেশের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে কেন এমন নেতিবাচক আহ্বান জানানো হলো, তা মোটেও আমাদের বোধগম্য নয়।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের একদল লবিস্টও কাজ করছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তারা বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য যেন না নেওয়া হয়, তার তদবির করতে ব্যস্ত। এই লবিস্টরা কারা? যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতার কাছে কোনো বিষয় তুলে ধরার জন্য লবিস্টরা কাজ করে থাকেন। লবিস্টরা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান—এমনকি কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের তথ্য দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্যও তথ্য তুলে ধরা এ লবিস্ট ফার্মের কাজ। এ পেশায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বা ফার্ম রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
তথ্যমতে, গত বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০টি লবিস্ট ফার্ম বা প্রতিষ্ঠান ছিল। লবিস্ট ফার্মকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের কাছে নিবন্ধন করতে হয়। এসব কর্মকাণ্ড তদারকি করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিভাগ। লবিস্ট প্রতিষ্ঠান যখন কাজ করে দেয় তখন প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি কাজের বিনিময়ে কত অর্থ পাবে সেটিও চুক্তিতে লেখা থাকে। তাই সঠিক হোক বা না হোক, নৈতিক হোক বা অনৈতিক—তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। এরা শুধু এজেন্ট হিসেবে কোনো স্বার্থান্বেষী কোম্পানি বা সংগঠনের বক্তব্যকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যাতে আমলে নেয় সেজন্য তদবির করে।
লাখ লাখ ডলার খরচ করে লবিস্টদের মাধ্যমে যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঘাত করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লবিং করছে, যারা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শান্তি মিশনে যাওয়া বন্ধ করতে চাচ্ছে, তারা কারা? আমাদের মনে রাখতে হবে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। সেনাবাহিনী, পুলিশ বা র্যাবে শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সন্তানরাই চাকরি করে না। এখানে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও মতের পরিবারের সন্তানরাও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে শান্তি মিশনে সদস্য যাওয়া বন্ধ হলে বা বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক কোনো নিষেধাজ্ঞা নেমে এলে দেশ যে ভয়ানক সংকটে পড়বে, এতে কারও সন্দেহ নেই। তবে যারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে এসব করাতে চাচ্ছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কাছে পরিষ্কার। দেশের ভালোমন্দের বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য অন্যকিছু।
১৩ জুন ২০২৩, জাতীয় দৈনিকের খবরের শিরোনাম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ভূমিকা রাখার আহ্বান’—এই মর্মে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টকে ইইউর ছয় এমপির চিঠি। এমন একটি চিঠি দেশের সুধী সমাজে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। প্রতিটি দেশই তার সংবিধান অনুসরণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করে এটিই সর্বজনবিদিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এতগুলো এমপির মধ্যে হঠাৎ ছয়জন এমপি কেন এমন স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠল? এতে অনুমান করা যায়, লবিস্ট নিয়োগের পরিধি আমেরিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
প্রত্যক্ষ করলাম, আমেরিকার ছয় কংগ্রেসম্যান দেশে সংখ্যালঘু এবং শরণার্থীদের প্রতি অবিচার হচ্ছে এই মর্মে একটি বিবৃতি দিয়েছে। আমার মতে, সর্বোচ্চ সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি এই সরকারের আমলে বিরাজমান। এরপরও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অবিচারের অভিযোগ নিতান্তই ষড়যন্ত্র। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। নারী, পুরুষ এবং শিশুরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচারের কাহিনি। হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষজন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানবতার প্রতিভূ জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্যাতিত শরণার্থীদের আশ্রয় দেন। তাই রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারের অভিযোগ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সরকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায়। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী খাতগুলোকে ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় নেওয়ার উদ্যোগই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মামলা ভূমি-সংক্রান্ত। এ নিয়ে বিস্তর বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। ‘জমি নিয়ে জালিয়াতি করলে সাত বছরের জেল’, সংসদে এমন আইন পাস অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষায় বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সবার জন্য খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে অবৈধভাবে খাদ্য মজুতদারদের জন্য সরকার সাত বছর জেল দেওয়ার আইন প্রণয়ন করেছে। শুধু দুর্নীতি করে দেশের অর্থ নিয়ে বিদেশে যারা পাচার করছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ছে সেই পরাক্রমশালী পশ্চিমা দেশগুলোর কারণেই। কারণ, ওই দেশগুলো ব্যক্তির টাকা দেখে নাগরিকত্ব দেয়। কখনো টাকার উৎস অনুসন্ধান করে না। ফলে এই সব ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যাদের কারণে কোনো দেশের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হচ্ছে, তাদের নাগরিকত্ব দানের মাধ্যমে সুরক্ষা প্রদান কোন মানবাধিকার রক্ষার আইনে পড়ে, তা জানতে আমাদের আগ্রহের অন্ত নেই।
১৮ কোটি মানুষের দেশে ভিন্ন দল ও মতাবলম্বী মানুষ থাকবে এটিই স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিহিংসা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপই যেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির ভাবমূর্তিকে বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল করে, এই প্রতিজ্ঞা হোক আপনার আমার সবার।
লেখক: ড. মো. নাছিম আখতার, উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
১৭ জুলাই ২০২৩
এজি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur