স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ৫০টি জাতীয় পতাকা সংবলিত সুবর্ণজয়ন্তী র্যালি হবে। যা দেশের ৬৪টি জেলা প্রদক্ষিণ করে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরবে। ১৬ ডিসেম্বরই সুবর্ণজয়ন্তীর বছরব্যাপী কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। এদিন মুজিববর্ষের কর্মসূচিও শেষ হবে।
সুবর্ণজয়ন্তীর মূল আয়োজক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বছরব্যাপী কর্মসূচির খসড়া প্রণয়ন করেছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২৬০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবও করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত কর্মসূচি অনুযায়ী মুজিববর্ষের মতো সুবর্ণজয়ন্তীতেও সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার কথা বলা হয়েছে। এতে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি বছরব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভারত, রাশিয়াসহ বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
ওই বৈঠকে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রস্তুতি কর্মসূচি প্রণয়ন করে মন্ত্রিসভা কমিটিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
যেসব কর্মসূচি প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো—বিশেষ দিনে সংসদ প্লাজা, হাতিরঝিল এবং অন্যান্য স্থানে রাতে লাইট অ্যান্ড লেজার ও ড্রোন শো আয়োজন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গণহত্যা বিষয়ক সেমিনার,আলোচনা সভা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার অবদান নিয়ে দেশব্যাপী ধারাবাহিক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ উত্তরীয়, টি-শার্ট,ক্যাপ,বীরাঙ্গনাদের শাড়ি বা শাল উপহার দেয়ার লক্ষ্যে জেলা-উপজেলায় অর্থ প্রদান,মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাতীয় কুইজ,রচনা,সংগীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি প্রতিযোগিতা আয়োজন করা।
মেলা বা উৎসব বা সম্মেলন আয়োজনের মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী মেলার আয়োজন,বছরভিত্তিক নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে মুক্তির উৎসব আয়োজন,বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক গ্লোবাল বিজনেস সামিট আয়োজন,মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য বা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা।
মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশের আয়োজন, জেলায় ৫০টি জাতীয় পতাকাবাহী র্যালি প্রদর্শনীর দিনে জেলা পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ আয়োজন, উপজেলা পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের আয়োজন করা।
বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে কর্মসূচি রয়েছে—সুবর্ণজয়ন্তী সৌধ , মিনার বা কলাম নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধ পদক প্রবর্তন, দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপন, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ হাজার বাসস্থান বা বীরনিবাস নির্মাণ ও হস্তান্তর, বীরের কণ্ঠে বীরগাথা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা রেকর্ড ও আর্কাইভকরণ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পরিচিতিমূলক ডিজিটাল সনদপত্র ও স্মার্টকার্ড প্রদান।
এছাড়াও আছে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সম্মাননা পাওয়া বিদেশি বন্ধুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, প্রচার ও আর্কাইভকরণ, মিত্রবাহিনীর নিহত সদস্যদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ উদ্বোধন (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ওই স্মৃতিস্তম্ভ বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে উদ্বোধন করতে পারেন), ভারতের ত্রিপুরায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুজিবনগর থেকে নদিয়া পর্যন্ত প্রস্তাবিত স্বাধীনতা সড়কের বাংলাদেশ অংশের নির্মাণকাজ শুরু করার কর্মসূচি।
প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ, বঙ্গবন্ধুর জীবনপঞ্জি প্রকাশ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অগ্রগতি বিষয়ক গ্রন্থ ও গবেষণামূলক পাণ্ডুলিপি প্রকাশের আর্থিক সহায়তা ও তা প্রকাশ, স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনপঞ্জি প্রকাশ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে প্রচার-প্রচারণার মধ্যে রয়েছে—সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার এবং মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই বিতরণ, বিশেষ মোবাইল গেমস, ডকুমেন্টারি, টিভিসি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রকলা প্রদর্শনী, সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি বিজ্ঞাপন, প্রামাণ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র নির্মাণ (নৌ-কমান্ডো আক্রমণের ওপর’অপারেশন জ্যাকপট’), দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে সুবর্ণজয়ন্তী কর্নার স্থাপন, জীবিত বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টকশোর আয়োজন ও বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার, চারুকলা ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে বিশেষ ভাস্কর্য প্রদর্শনী।
সমাপনী অনুষ্ঠান হবে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিনে। ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এছাড়া বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মাননা পাওয়া বিদেশি বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
১৬ ডিসেম্বর ৫০টি জাতীয় পতাকা সংবলিত র্যালি সব জেলা প্রদক্ষিণ শেষে ঢাকার মূল অনুষ্ঠানে আসবে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে পতাকা তুলে দেবেন। রাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের নৈশভোজের আয়োজন করা হবে। দেশাত্মবোধক সংগীত, নৃত্য, আতশবাজি, আলোকসজ্জা ইত্যাদির মাধ্যমে বছরব্যাপী আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষণা হবে।
প্রাথমিক বাজেট
সুবর্ণজয়ন্তীর প্রস্তুতি সভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেট নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ৫টি জাতীয় দিবস উদযাপনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে এর ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে না। এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থেকে কিছু প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে, যা বাস্তবায়ন করা গেলে স্বাধীনতার চেতনা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
আর্থিক অপর্যাপ্ততার কারণে এসব কর্মসূচি সরকারি বরাদ্দে করা সম্ভব না হলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জোরালো মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্পন্সর সংগ্রহ করে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সুবর্ণজয়ন্তীর উপলক্ষে ২৬০ কোটি টাকা প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে এক লাখ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্রন্থাগারের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকা, জেলা প্রশাসনের জন্য এক কোটি করে ৬৪ কোটি টাকা, উপজেলা প্রশাসনের জন্য ৩০ লাখ ধরে (সদর উপজেলা বাদে) ১২৮ কোটি ৬০ লাখ, ডকুমেন্টারি ও শটফিল্ম তৈরি বাবদ ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রমের জন্য ১৫ কোটি টাকা।
ওই বৈঠকে সুবর্ণজয়ন্তীর লোগো, থিম সং নির্বাচন ও ওয়েবসাইট তৈরির জন্য চারটি উপ-কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। লোগো নির্বাচন কমিটির আহ্বায়ক করা হয় শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনিকে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সদস্য এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড.কামাল আবদুল নাসেরকে সদস্য সচিব করা হয়।
থিম সং নির্বাচন উপ-কমিটির আহ্বায়ক করা হয় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে। এ কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, অসীম কুমার উকিল এবং সদস্য সচিব শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ওয়েবসাইট তৈরি উপ-কমিটির আহ্বায়ক করা হয় যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। কমিটির সদস্যরা হলেন তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম এবং সদস্য আব্দুল মান্নান (পরিচালক-এটুআই)।
ড. কামাল আবদুল নাসেরকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় কনটেন্ট নির্ধারণ উপ-কমিটি। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড.মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক,তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি। সদস্য সচিব নির্বাচন করা হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে।
ঢাকা ব্যুরো চীফ , ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
এজি