রাশিয়ার বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোঁরায় চাকরির প্রলোভন। কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও লোভনীয় বেতন। ওভারটাইমসহ বাংলাদেশি টাকায় ৭০ হাজার টাকা বেতন। চুক্তিনামার সঙ্গে ভিসা ও উড়োজাহাজের টিকিট প্রদর্শন। ফ্লাইটও কনফার্ম। বাকি থাকলো ওড়ার পালা।
এভাবে অনেকের কাছ থেকে নেওয়া হলো চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা করে। শুক্রবার দুপুরে ফ্লাইট। তার আগের দিন সকলকে নিয়ে বিদায় সংর্বধনার আয়োজন! সেখানে সকলকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানোর কথা। সেই সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন।
প্রিয় স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবাই ছুটে গেলেন সেই কার্যালয়ে। দেখলেন, সেখানে কেউ নেই, তালা ঝুলছে! বিস্ময় আর হতাশায় চোখ কচলালেন অনেকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ভিসা জাল, উড়োজাহাজের টিকিটও ভুয়া।
আর এ খবরটি পেয়ে মাথায় হাত পড়লো প্রবাস গমনেচ্ছু অর্ধশতাধিক ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের। আর এভাবে স্বপ্ন দেখিয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষদের কাছ থেকে কোটি টাকা নিয়ে উধাও সস্ত্রীক শরিফুল ইসলাম (৩৬)।
বাহারি ভিজিটিং কার্ডে শরিফুল ইসলামের পরিচয়- তিনি এসএমএন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কথিত গ্রুপটির স্লোগান ‘ড্রিভেন ফর দ্য বেটার ফিউচার’।
সেই স্লোগানই এখন অন্ধকার আর অনিশ্চয়তার পথে বসিয়েছে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলোকে।
কথিত এ গ্রুপের অধীনে দেখানো কথিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- জনশক্তি প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান এসএম ইন্টারন্যাশনাল, এসএম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম, এসএম ফ্যাশন, এসএম এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট। মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামের ইয়াছ উদ্দীন বিশ্বাস ও মৃত মনোয়ারা বেগমের ছেলে শরিফুল ইসলামের প্রতারণায় এভাবেই পথে বসেছেন সাভারের বিভিন্ন এলাকার নিরীহ বিদেশ গমনেচ্ছু যুবকেরা। তারা ওই প্রতারকের কার্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি কোথাও গিয়েও কোনো কূল কিনারা পাচ্ছেন না।
শরিফুলের বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, যে ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে তিনি ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন, সেটিও (১৯৮৬১৯১১৮১১৭৭৭০৫৮৮) ভুয়া। কেবল তার পার্সপোর্ট নং – BJ 0758080 সঠিক পাওয়া গেছে। কথিত স্ত্রী শামিমা মুক্তাকে নিয়েই খুলে বসেছিলেন ্ে প্রতারণার ব্যবসা।
সাভারের রাজাসন এলাকার মৃত শামছুল হকের ছেলে ফজলুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার বন্ধু শরিফ উদ্দিন মোল্লাকে নিয়ে রাশিয়া যাওয়ার জন্য দু’জনে মিলে ৯ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলাম এসএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হাতে’।
‘ভিজিটিং কার্ডে যার এতো বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তিনি আমাদের টাকা মেরে দেবেন, তা কল্পনাতেও ভাবিনি’।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফজলুল হক আরও বলেন, ‘আমার পরিবার ধার-দেনা আর সুদে টাকা যোগাড় করেছিলো। এখন বিদেশে যেতে না পারলে আমাদের আত্মহত্যা করতে হবে’।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সোহাগ দিয়েছিলেন ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কথা ছিলো ফ্লাইটের দিনই সকালে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে দেবেন।
এভাবেই সোহেল, মাহবুব, আলম, হোসেন, রনি, ফজলুল হক, শরিফ মোল্লাসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন ওই প্রতারক।
শ্যামলীর রিং রোডের ৫ নম্বর সড়কে পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটির ৫ নম্বর বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়েই প্রতারক দম্পতি খুলে বসেছিলেন কথিত এ রিক্রুটিং ফার্ম। যার লাইসেন্স পর্যন্ত নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাড়ির মালিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার বাসা ভাড়া নিয়ে এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে শরিফুল ইসলাম মানুষের কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন- তা কখনোই ভাবনাতেও পারিনি । পরে বিষয়টি জানাজানি হবার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, যে ভোটার আইডি উল্লেখ করে শরিফুল বাড়িভাড়া নিয়েছিলেন সেটিও সঠিক নয়’।
শরিফুলের জন্মস্থান মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, একটি অসামাপ্ত একতলা বাড়িতে এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন শরিফুলের বাবা ইয়াছ উদ্দীন বিশ্বাস।
শরিফুলের বাবা বাংলানিউজকে জানান, তার আরেক ছেলে কুয়েত প্রবাসী। ছেলে একটি গ্রুপের ব্যবসা পরিচালক। যার অধীনে বহু প্রতিষ্ঠান। এমন একটি ভিজিটিং কার্ড দেখালে চমকে ওঠেন তিনি।
তিনি বলেন, তার ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। নিজেরই চলে না বলে বাড়িতে কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেন না। এমনকি বৃদ্ধ বাবা ও অসহায় ভাইদের খোঁজ খবর পর্যন্ত নেন না। বাড়ির কাজ শুরু করলেও অর্থাভাবে ঘরে দরজা বা পলেস্তরার কাজ করতে পারেননি এখনো।
জসিম উদ্দিন নামের একজন গ্রামবাসী বাংলানিউজকে জানান, শরিফুলের সন্ধানে প্রায়ই অচেনা অজানা লোকজন গ্রামে আসেন। তারা খোঁজ খবর করেন। অনেক এসে শরিফুলের ঘর-বাড়ি দেখেই মূর্চ্ছা যান।
আবুল কালাম নামের আরেকজন গ্রামবাসী বাংলানিউজকে জানান, শরিফুল ১০ বছর আগে রাশিয়া গিয়েছিলেন। সেখানকার বিভিন্ন কাজের ছবি তুলে গ্রামে পাঠিয়ে সেখানে লোক নেওয়ার নাম করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দেশে ফিরে আসেন।
এ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতারণার মামলা থাকায় গত ১০ বছরে আর গ্রামমুখো হননি শরিফুল।
এ ব্যাপারে সাভারের কৃষ্টপুরের ফজলুল হক গত ২৮ মে (শনিবার) বাদী হয়ে প্রতারক শরিফুল ইসলাম ও তার কথিত স্ত্রী শামিমা মুক্তার বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানার একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন, যার নম্বর ১৬৬৮।
সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, মোবাইল নেটওয়ার্ক ধরে তাদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, শামিমা মুক্তা তার প্রকৃত স্ত্রী নন। প্রতারণার অংশীদার মাত্র। শরিফুল ইসলাম উচ্চ মাপের প্রতারক। তার বিষয়ে র্যাব ও ইমিগ্রেশন বিভাগকেও অবহিত করা হয়েছে, যাতে তিনি দেশ ছাড়তে না পারেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে শরিফুল ইসলামের ০১৭১৮২৫৯৮৭৩, ০১৭০৩৭৯৬৯৭৫, ৯১২৯৫৩৮ ও তার কথিত স্ত্রী শামিমা মুক্তার ০১৬৮৫০৭০৩৪৬ নম্বরে বহুবার ফোন করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলেছে, তার কার্ডে ব্যবহৃত সবগুলো মোবাইল ফোন নম্বরই অনিবন্ধিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব নামে এসব সিম কেনা হয়েছিলো তার ভোটার আইডি কার্ড ও ঠিকানা সবই ভুয়া। (সূত্র- বাংলানিউজ)