পলিথিন স্থল মাইনের চেয়েও ভয়াবহ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও উপকারের দিক বিবেচনা করে পলিথিন পরিত্যাগ আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। শপিংব্যাগ থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্য কিংবা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংরক্ষণ করতেও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন ব্যবহারের উপকারিতা জানলেও আমরা এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ রয়ে গেছি। পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন যে,‘পলিথিন দূষণস্থল মাইনের চেয়েও মারাত্মক।’

পলিথিন একধরনের পলিমার ফাইবার দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। প্রথম তৈরি করা হয় ইংল্যান্ডের ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির গবেষণাগারে;সেটি ১৯৩৩ সালের দিকে। অপরদিকে ঠিক ৪৯ বছর পর অর্থাৎ ১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে পলিথিনের উৎপাদন আরম্ভ হয়। তখন এটি মানুষের হাতে হাতে পৌঁছতেই এর সাময়িক উপকারিতায় মুগ্ধ হয়ে দেশবাসী পলিথিনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন দ্রুত।

ফলে, এটি বাণিজ্যিক দিক দিয়ে দ্রুততম প্রসার ঘটে এবং দেশের বৃহত্তর বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে স্থান করে নেয়। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই পলিথিনের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে স্বল্প সময়ের মধ্যে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ৭৫০ কোটি টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

সাধারণত আমাদের দেশে পলিথিন ১২০ থেকে ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ মাত্রায় পোড়ানো হয়। এতে কিন্তু পলিথিন সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় না। এটিকে বিনষ্ট করতে হলে ৭ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরের তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়,নয়তো ডাইঅক্সিন জাতীয় একধরনের বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। যে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় ফুসফুস ও ত্বকে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। এছাড়া পলিথিন পোড়ানোর সময় হাইড্রোজেন সায়ানাইড নামক এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টির কারণে দহনকারী ব্যক্তি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।

আমাদের অনেকেরই জানা নেই,পলিথিন মুড়িয়ে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করলে একধরনের অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ে তা। পরবর্তী সময়ে সেই খাদ্যদ্রব্য বের করে আনলে ‘স্টাইরিন’ নামক গ্যাস উৎপাদিত হয়ে নিঃশ্বাস ও লোমকূপের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যার ফলে মাথাব্যথা, দুর্বলতা,জটিল ও কঠিন রোগব্যাধি সৃষ্টি হয়; এমনকি স্নায়ুতন্ত্র বিকলের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। অন্যদিকে প্লাস্টিকের পানির বোতল ও ট্যাপ ব্যবহারের প্রবণতার কারণে মানুষের প্রজননক্ষমতা হ্রাস, অ্যালার্জি, হাঁপানি, চর্মরোগ,থাইরয়েডের অতিরিক্ত হরমোন ধারণ এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়। অনেকে আবার খাবারকে নিরাপদে ঢেকে রাখতে রঙিন পলিথিন ব্যবহার করেন,যা আরো মারাত্মক।

পলিথিন ব্যবহারে শুধু খাদ্যে বিষক্রিয়াই ঘটে না,ঘটে ড্রেনেজ ব্যবস্থারও বিপত্তি। কারণ পলিথিন শতশত বছর ধরেও সক্রিয় থাকতে সক্ষম। এটি মাটির নিচে অথবা পানিতে দ্রবীভূত হয় না। পলিথিন উৎপাদনে যে পলিমার ব্যবহার করা হয়, তা খুবই শক্তিশালী এবং যে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া এর ভেতরে প্রবেশ করে নষ্ট করতে পারে না বলেই শত বছরেও অক্ষয় থেকে যায়। এ কারণে মাটির উর্বরাশক্তি হ্রাস পায় এবং সুয়ারেজ বা ড্রেনে আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। এ ধরনের জলাবদ্ধতায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা তো ভেঙে পড়েই,তার ওপর ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু মশার উপদ্রবও বাড়ে।

এ ছাড়াও ফসলের জমিতে পলিথিনের মিশ্রণের কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নদনদী এবং সমুদ্রে পলিথিনের বর্জ্য নিক্ষেপণের ফলে জলজ প্রাণীদের জীবনহানি ঘটছে ব্যাপকভাবে। খাদ্য ভেবে জলজ প্রাণীরা পলিথিনের বর্জ্য খেয়ে হজম করতে না পেরে পরিশেষে প্রাণ হারায়। এভাবে অনেক তিমি,কাছিমসহ অসংখ্য জলজপ্রাণি প্রাণ হারিয়েছে।

সমীক্ষায় দেখা যায়,প্রতি মিনিটে সাগরের জলে ৩৫ হাজার প্লাস্টিক পণ্য যে কোনো ভাবে পড়ছে;যার সংখ্যা বছরে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ মিলিয়ন। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে কার্বন নিঃসারণ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কারণ প্রতি বছর সারা পৃথিবী জুড়ে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পোড়ানো হচ্ছে,তাতে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়ে জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

উল্লেখ্য,সাগরে নিক্ষিপ্ত পলিথিন বর্জ্যের কারণে সূর্যরশ্মির বিকিরণে মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়ে জলজ প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে। এতে প্রায় ৮৫০ প্রজাতির জলজ প্রাণী রোগে আক্রান্ত হয়।

এছাড়াও বছরে ১০-১২ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, ২০২২ সালে মার্চ মাসে বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় জানা যায়, মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ রয়েছে।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে এ ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি রয়েছে, যা মানুষের রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্থান করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।

গবেষকেরা আরো জানিয়েছেন,অর্ধেক নমুনায় পিইটি প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। যে উপাদানটি পানীয় বোতলে ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য পণ্যের প্যাকেজে ব্যবহৃত পলিস্টাইরিন মিলছে এক তৃতীয়াংশ মানুষের রক্তে। অন্যদিকে এক-চতুর্থাংশ রক্তের নমুনায় পলিথিন শনাক্ত হয়েছে, যা থেকে সরাসরি বিভিন্ন ধরনের পলিব্যাগ তৈরি করা সম্ভব।

পলিথিনের মারাত্মক দূষণের বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নত দেশগুলো পচনশীল পলিথিন তৈরি করছে। তারা পচনশীল পলিথিন বা প্লাস্টিক তৈরিতে ভুট্টা বা চালের স্টার্চ মিশিয়ে দিচ্ছে। এতে পলিথিন মাটিচাপা পড়লে খুব দ্রুত ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ে অণুগঠন হারিয়ে ফেলে। তার সঙ্গে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা নিঃশেষ হয়ে যায়।

অবশ্য দ্রুত বিনষ্ট হওয়াটা নির্ভর করে মিশ্রিত স্টার্চের পরিমাণ এবং মাটির গঠন ও তাপ আর্দ্রতার পরিমাণের ওপর। আমাদের দেশে যেহেতু ঐ প্রযুক্তির ব্যবহার নেই,সেহেতু পলিথিন ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা উচিত। যাতে হাতল ছাড়া শপিংব্যাগও বাজারে প্রবেশ করতে না পারে, সেই ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নেয়া।

বিষয়টি কঠিনই বটে। কাজটি শুধু আইন প্রয়োগ করেই সমাধান করা যাবে না। এটি সমূলে নির্মূল করতে হলে আগে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। ক্ষতির দিকটা যত বেশি জানাজানি হবে,ততই মানুষ সচেতন হয়ে উঠবেন।

লেখক : আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, ৯ এপ্রিল ২০২২ ।

Share