রাজনীতি

স্ত্রীকে খুশি করতে গিয়ে আবারো ফেঁসে যাচ্ছেন লতিফ সিদ্দিকী

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক:

আওয়ামী লীগের সমালোচিত সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আসা ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে তার দুর্নীতি অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি।

দুদক সূত্র জানায়- মসলিন কটন মিল, মোহিনী জুট মিলস, চিশতি টেক্সটাইল বিনা টেন্ডারে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অন্যদের কাছে হস্তান্তর করার অভিযোগ সংক্রান্ত বেসরকারিকরণ বা হস্তান্তরকরণ সংক্রান্ত নথিপত্র অনুসন্ধানী কর্মকর্তার হাতে এসেছে। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম সমিতিকে দেয়া সরকারি সম্পত্তি অবৈধ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরের যাবতীয় রেকর্ডপত্রও সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব তথ্যপত্র তার সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। যেগুলো অল্প কিছুদিন পরই যাচাই-বাছাই শুরু হবে। এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে লতিফ সিদ্দিকীকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হতে পারে। সেই সঙ্গে আনিত অভিযোগে সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।

লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ দুদকে:
দুদকে আসা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মহাজোট সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী দায়িত্বে থাকাকালীন অনেক কিছুই করেছেন নিজের খামখেয়ালীবসত। ২০১৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার চারদিন আগে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নিশাত জুট মিলের ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি ঢাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম সমিতিকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেন। মতিঝিলে মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকারও বেশি হলেও এ জমি মাত্র ১ কোটি ১ লাখ টাকায় ৯৯ বছরের জন্য ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতিকে ইজারা দিয়েছিলেন। এছাড়া ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মোহিনী জুট মিল, মুসলিম কটন মিল ও চিশতি টেক্সটাইল বিনাটেন্ডারে হস্তান্তর করেন সাবেক এই মন্ত্রী। এসব কারখানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তিনি কোনো নিয়ম মানেননি বলেও দুদকে আসা অভিযোগে বলা আছে।

জমিটি ইজারা অনুমোদনের নথিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী লিখেছিলেন, ‘মেজবান চট্টগ্রাম সমিতির একটি আকর্ষণীয় বাৎসরিক অনুষ্ঠান। ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলা কন্যার পানি গ্রহণ করেছি। ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। তাদের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় এই ভূমি খণ্ডটির প্রয়োজনিয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ করছি।’ বলা ভালো যে ওই সমিতির সভাপতি লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী।

মসলিন কটন মিল: গাজীপুরের কালীগঞ্জের মসলিন কটন মিল বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধিনে ন্যস্ত করা হয়। এরপরও ২০১১ সালে এটি রিফাদ নামে একটি পোশাক কারখানার কাছে ১৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয় লতিফ সিদ্দিকির দায়িত্বে থাকা অবস্থায়। অভিযোগে বলা আছে, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া মিলটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা এবং এর দায়দেনা ও মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। সরকার ও ক্রেতা পক্ষ শ্রমিকদের বকেয়া পাওনার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল। এসব অনিয়মকে লতিফ সিদ্দিকী প্রশ্রয় দিয়েছেন বলেই অভিযোগ আছে।

মোহিনী মিলস বিক্রি: কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলস লিমিটেড লোকসানের কারণে ১৯৮২ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে দরপত্রের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি সেটি কিনে নিয়ে নামকরণ করেন শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলস। তখন মিলটির বিক্রয়মূল্য ছিল ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। নজরুল ইসলাম টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারায় দরপত্র বাতিল করা হলে তিনি আদালতে মামলা করেন।

২০০৯ সালে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালার নির্দেশ দিলে মামলা প্রত্যাহারের শর্তে ওই প্রতিষ্ঠানকে কিস্তি, দায়দেনাসহ ৪৯ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য বলা হয়। পরে শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলের পক্ষে দ্য পিপলস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামে একটি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধে রাজি হয়। কিন্তু মামলা প্রত্যাহার বা টাকা পরিশোধ না করায় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী মিলটি ফেরত না নিয়ে একক সিদ্ধান্তে আবদুল মতিন নামের আরেক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও কোনো টাকা পরিশোধ করেননি।

এরপর এনারগোটেক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আরিফুর রহমানের সঙ্গে মিলটি বিক্রির জন্য চুক্তি করা হয়। তিনিও সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করেননি। এরপর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বারবার মিলটি বেসরকারি কমিশনের কাছে ন্যস্ত করার কথা বললেও মন্ত্রী নিজেই তা বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। বিক্রির পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল অবৈধ। এছাড়া মিলটি প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগে বলা আছে।

চিশতি টেক্সটাইল: কুমিল্লার দৌলতপুরের ঐতিহ্যবাহী চিশতি টেক্সটাইলের ১৬ দশমিক ৬৬ একর জমিসহ মিলটি বিনাটেন্ডারে মাত্র ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ ওই জায়গার সর্বনিম্ন বাজার মূল্য কমপক্ষে ১৫০ কোটি টাকা। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মিলটি বিনাটেন্ডারে ২০১০-২০১১ অর্থবছরে মন্ত্রীর ইচ্ছায় মাত্র ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। ওই মিলটি কিনেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আমস ফারাজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মালিক মো. ফারুক ইসলাম ভূঁইয়া।

দুদক সূত্র জানায়, লতিফ সিদ্দিকীর কর্মকাণ্ড বিশেষ করে ওই মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে আইন ও বিধি মানা হয়েছে কি না এবং চুক্তির শর্ত মেনে সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্যই গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক পবন চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি পরে গত ৩১ আগস্ট বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানী কর্মকর্তা ও উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনটিসহ তার অনুসন্ধানের সংশ্লিষ্ট আরো রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন। যেগুলোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া কিছুদিন পর শুরু হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় মন্ত্রিসভা ও দল থেকে অপসারিত হন লতিফ সিদ্দিকী। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও দেশের ১৮টি জেলায় অন্তত ২২টি মামলা রয়েছে। দেশে ফিরে এসে গত ২৫ নভেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করলে লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনি। (বাংলামেইল)

চাঁদপুর টাইমস : ডেস্ক/ডিএইচ/২০১৫

Share