স্তন ক্যানসার একটি নীরব ঘাতক। বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে প্রায় ১৫ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। প্রতি ১ হাজার নারীর মধ্যে ২২ দশমিক ৫ জন নারীর স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। স্তন ক্যানসারের জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছেন সেসব নারী, যাঁদের পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের স্তন ক্যানসারের ইতিহাস আছে, বিআরসিএ১ বা বিআরসিএ২ জিনের মিউটেশন (পরিবর্তন) আছে। এই লক্ষণগুলো ডিম্বাশয়ের ক্যানসার বা ওভারিয়ান ক্যানসারের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
এদিকে কম বয়সীরাও ঝুঁকিমুক্ত নন। কারণ সমীক্ষা বলছে, ২০-৩০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৪ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ৩০-৪০ বছরের নারীদের মধ্যে আক্রান্তের হার ১৬ শতাংশ, ৪০-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ ও ৫০ বছরের ওপরের নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ।
ওজন নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক পরিশ্রম এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে ওজন বৃদ্ধি পায়, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এই রোগের লক্ষণগুলো ও এর চিকিত্সা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।
স্তন ক্যানসারে সব সময় ব্যথা ও পিণ্ড থাকবেই, এমন ভাবনা ভুল। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যথা অনুভূত হয় না, তবে কিছু রোগী শেষ পর্যায়ে এসে ব্যথা অনুভব করেন। স্তনে পিণ্ড হওয়া স্তন ক্যানসারের একটি উপসর্গ, কিন্তু এ ছাড়াও আরও নানা লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন স্তনবৃন্তের যেকোনো পরিবর্তন, রক্ত নির্গমন, লালচে হয়ে যাওয়া, বগলের নিচে পিণ্ড অনুভব করা।
স্তন ক্যানসারের চিকিত্সা নিয়ে অনেক ভুল ধারণা ও বিশ্বাস নারীদের মধ্যে দেখা যায়। সবারই একটি ভয় থাকে যে অস্ত্রোপচার করে পুরো স্তন কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু এখন রোগীর ক্যানসারের পর্যায়ের ওপর ভিত্তি করে সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট নিরাময় নিশ্চিত করতে অস্ত্রোপচার করে থাকেন। ক্যানসার চিকিত্সার মূল লক্ষ্য থাকে দুটি। এক. রোগীর সম্পূর্ণ টিউমার অপসারণ করা। দুই. ক্যানসার যেন আবার ফিরে না আসে, তা নিশ্চিত করা।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে অস্ত্রোপচার করে শুধু টিউমার ও সংলগ্ন অংশ অপসারণ করা হয়, একে বলে লাম্পেক্টমি। পুরো স্তন যদি অপসারণ করতে হয়, তাকে বলে মাস্টেক্টমি। পুরো স্তন অপসারণ করতে হলেও, স্তন আগের মতো পুনর্গঠন করার সুযোগ রয়েছে সার্জারির মাধ্যমে।
অনেকে জানতে চান, স্তন ক্যানসার হলে সব সময় কি কেমোথেরাপি নিতে হয়? তাঁদের জন্য বলি, যদি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে, তাহলে অনেক সময় কেমোথেরাপির প্রয়োজন না–ও হতে পারে। ক্যানসারের ধাপ নির্ণয় করে পরবর্তী সময়ে কেমোথেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্যানসার চিকিত্সা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে অনেক রোগী আর অনকোলজিস্টের কাছে যেতে চান না। কিন্তু ক্যানসার যদি প্রাথমিক পর্যায়েও থাকে, তবু আবার ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। তাই সব ক্যানসার রোগীরই নিয়মিত অনকোলজিস্টের কাছে ফলোআপ চিকিত্সা নেওয়া প্রয়োজন।
স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে বয়স ও পারিবারিক ইতিহাস আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে শুধু ৫-১০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার বংশগত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও উন্নত জীবনযাপনের অভ্যাসের মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়াম, নিয়ন্ত্রিত ওজন, শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করা ভালো।
মনে রাখতে হবে, স্তন ক্যানসার শুরুতেই শনাক্ত করা গেলে সহজে চিকিত্সাযোগ্য ও নিরাময়যোগ্য। একজন নারী চাইলেই নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করতে পারেন। তাই স্তন ক্যানসার নিয়ে ভয় নয়, বরং প্রত্যেক নারীকে সচেতন থাকতে হবে।
বার্তাকক্ষ,২২ অক্টোবর,২০২০;