তামান্না সেতু :
দু’মাস হয়েছে ছোট ছেলে তুর্য’র জন্মের। বড় ছেলে আর্য’র বয়স সাত। আমার স্বামী বদলী চাকরীতে আমাদের ছেড়ে তখন ঢাকার বাইরে। কাছের বন্ধুদল সকলেই দেশের বাইরে– কেউ পড়তে, কেউ জীবিকার সন্ধানে। বাইরে খুব একটা বের হতাম না। একঘেয়ে জীবন কাটছিল আমার।
সেই সময়টাতে একদিন আমার বন্ধু তানভীরের ছোট ভাই শুভ্র বাসায় এলো, সাথে এক বন্ধু। শুভ্রকে আমি একরকম কোলে পিঠে করে বড় করেছি। ও তখন এসএসসি দিলো সবে। ও প্রায়ই এসে আমার বাসার টুকটাক কাজগুলো করে দিয়ে যেত।
সেদিনও এসেই ঢুকেছে রান্নাঘরে, কী আনতে হবে বাজার থেকে, তাই দেখতে। আর আমি অসামাজিক-বান্দা কোনমতে ওর বন্ধুটির নামধাম জেনে তার কোলে তুর্যকে দিয়ে প্রিয় বারান্দায় যেয়ে বসলাম।
ছেলেটির নাম ফাহাদ।
বাজার করে দিয়ে ওরা চলে গেলো।
দিন চার-পাঁচ পর ফাহাদ এক বিকেলে একাই এসে হাজির। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম- এদিকে কোথাও এসেছিলে?
বললো, বিকেলটা ও বাড়িতে একাই থাকে। তাই বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে এসেছে।
ভাবলাম, হতেই পারে। বাচ্চাদের ওর কাছে রেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত উঁচু আওয়াজে দিয়ে আমি বারান্দায় যেয়ে বসলাম। এ বারান্দার গাছগুলোউ আমার সন্তানের মত। দু’বেলা এদের পাশে না এসে বসলে কেমন মনটা খারাপ হয়ে যায়। অথচ ছোট ছেলেটা হবার পর থেকে গাছ গুলোর দিকে তাকানোই হয় না।
এরপর থেকে রুটিন হয়ে গেলো। ফাহাদ রোজ বিকেলে চলে আসতো বাচ্চাদের নিয়ে খেলতে। আমি মনযোগী হতাম বারান্দার গাছ আর রবি ঠাকুরের গানের প্রতি।
ফাহাদের সাথে কথা হতো খুব কম। ভেতর বাড়িতে ও তেমন আসতো না। আমি সাধারন কোন প্রশ্ন করলেউ কেমন চুপসে যেত। ও থাকতো অস্পষ্ট এক ছায়া হয়ে।
প্রায়ই সকালে ঘুম ভেঙে দেখতাম, বসার ঘরে মাথা নিচু করে ফাহাদ বইয়ের সেলফ পরিষ্কার করছে বা খেলছে বাচ্চাদের সাথে। কখনো কখনো গাছের মরা পাতা পরিষ্কার করতো। খালি টবে অন্য গাছের ডাল কেটে চাড়া দিতো। আমার যা কিছু ভাললাগার ছিল তার সব কিছুর দিকে ওর খেয়াল। কতো সকাল ঘুম ভঙ্গেছে রবি ঠাকুরের গানের সুরে। উঠে দেখেছি ফাহাদ মিউজিক প্লেয়ার অন করে খেলছে বাচ্চাদের নিয়ে।
আগস্টের আট তারিখ আমার জন্মদিন। দুদিন আগেই আমার মা চলে এলো। স্বামী ছুটি পেল না।
মার সাথে কেনাকাটা, ঘর সাজানো, বাবুর্চি ঠিক করাসহ সব কাজে ফাহাদ আছে। আমি নিশ্চিন্ত, নির্ভার।
উৎসবের আগের দিন অকারনেই একবার ভেতর বাড়িতে এসে দুপাক ঘুরে গেল ও । আসে না এভাবে কখনো। আমার অনভ্যস্ত চোখ ওকে দেখে একটু ভ্রু কঞ্চন করায় আবার যেয়ে বাইরের ঘরে বসল।
উৎসবের দিন ফাহাদের দেখা নেই। আমি দু-চারবার বারান্দায় উঁকি দিলাম। শুভ্র ঢাকার বাইরে বলে ফাহাদের খোঁজ নিতেও পারছি না। আমার সেই প্রথম মনে হোল, ফাহাদের ফোন নম্বর বা বাড়ির ঠিকানা আমি জানি না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, উৎসব শেষ -ফাহাদ এলো না।
রাতে ঘুমাতে গিয়েছি। একটার দিকে মুঠোফোন বেজে উঠলো। অপরিচিত নম্বর।
– হ্যালো, কে বলছেন?
– আমি ফাহাদ।
– ফাহাদ? তুমি আসোনি কেন আজ? শরীর খারাপ?
– আপনি আজ বিকেলে বারান্দায় এলেন না কেন? গাছগুলোতে পানি দেয়া হলো না।
– ও হ্যাঁ, তাই তো। সকালে দিয়ে দেবো। তুমি এলে না কেন?
– আজ সারাদিন কি সব হিন্দি গান বাজলো আপনার বাড়িতে! অথচ আপনি এসব পছন্দ করেন না।
– এতো মেহমান বাড়িতে। নিজের পছন্দে সব চলে বল?
-ও।
– তুমি এলে না কেন?
– আপনি তো বলেন নাই আমাকে আসতে।
– ওমা, তোমাকে বলার কী আছে? তুমি তো এ বাড়িরই মানুষ।
-আমি আপনাদের বাড়ির? বলুন তো আমার চশমার ফ্রেমের রঙ কী?
– তোমার চশমার ফ্রেম? কালো, কালোই তো ।
–
বেশ বুঝতে পারছিলাম ফাহাদের গলা ভেজা। বলল-
– আপনি কিছু জানেন না। আমার ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, আমরা কয় ভাই-বোন, আমার এসএসসি-র রেজাল্ট, কিছুই জানেন না আপনি। চশমার ফ্রেমটাও তো নীল।
ফোনের ওপাশে ফাহাদ কাঁদছে।
আমি বিব্রত। আসলেই তো, আমি কিছু জানি না । পেছনের ছ’টা মাস বাড়িটাকে ও নিজের মত করে দেখেছে। কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে ছেলেটা এখানে পড়ে থাকতো, সেই প্রশ্নও তো আসেনি আমার মনে।
পরিবেশ হালকা করতে বললাম– কাল সকালে চলে এসো কেমন। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।
– আমি আপনার বাসার নিচে দাঁড়ানো। জন্মদিনের উপহার নিয়ে বিকেল থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি নিচে আসুন, প্লিজ।
আমি বিছানা ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বুঝতে পারছিলাম, সমাজের নির্দিষ্ট নিয়ম ডিঙিয়ে এই ছেলে বড়ো অজায়গায় তার ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছে। ফোনের ওপাশে ফাহাদ কি কি যেন বলেই যাচ্ছে, ওর গলার স্বর ক্রমশ উঁচু হয়েই যাচ্ছিলো, কেঁদেই যাচ্ছে, রাত বাজে প্রায় দু’টা।
– প্লিজ আপনি কি একবার নিচে আসবেন? অ্যাটলিস্ট বারান্দায় আসুন। আপনি কি শাড়ি পরে আছেন? প্লিজ, কথা বলুন। আমি আপনার জন্য কাজল নিয়ে এসেছি। আপনি নিজের পয়সায় আর কখনো কাজল কিনবেন না। কথা বলুন, চুপ করে থাকবেন না, প্লিজ। আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমাকে? হ্যালো… হ্যালো…
দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে আমি মুঠোফোনের সুইচ অফ বাটনের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ছিলাম।
দিনের পর দিন আমি আর প্রিয় বারান্দায় যাইনি। আমার ফোনটা সুইচ অফ হয়েই পড়ে থাকতো। কেউ দরজা নক করলে চমকে উঠতাম।
রাত দুটোয় একটা কথারও উত্তর না দিয়ে ফোন অফ করে দেয়ার পরও ফাহাদ টানা তিনমাস আমার বাড়ির নিচের রাস্তায় বসে থাকতো। আমি রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় ও মাথা নিচু করে খানিকটা পথ হেঁটে যেতো আমার পেছনে। এরপর, কবে থেকে কে যানে, আর ওকে দেখা যায়নি এ পথে।
আমিও সহজ ভাবে সংসারে মন দিয়েছি। সমাজে মান ঠিক রেখে চলার দায় তো আমার অস্বীকার করলে চলে না।
তারপরও সমস্ত পৃথিবীর আড়ালে যে আমি আমার। তার কাছে অস্বীকার করার উপায় নেই– “সেই রাতে আমিও মেঘ হয়েছিলাম”।