Home / চাঁদপুর / ‘সেলফি আগ্রাসনে’ হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের ফটো স্টুডিও
‘সেলফি আগ্রাসনে’ হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের ফটো স্টুডিও
চাঁদপুর শহরের একটি স্টুডিওতে এভাভেই ছবি তুলতে দেখা যাচ্ছে এক তরুনকে। পাশে রেললাইনে বসে একদল তরুণের স্মার্টফোনে সেলফি তোলার দৃশ্য। ছবি আশিক বিন রহিম।

‘সেলফি আগ্রাসনে’ হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের ফটো স্টুডিও

মোবাইল সেলফির আর ডিজিটাল ক্যামেরার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে চাঁপুরের ফটো স্টুডিও ব্যবসা। ঐতিহ্যবাহী এই স্টুডিও শিল্পে মন্ধাভাব দেখা দেয়ায় অনেক স্টুডিও মালিক তাদের ব্যাবসা গুটিয়ে নিয়েছে।

ফলে ক্যামেরার পেছনে চোখ রেখে ‘রেডি ওয়ান, টু, থ্রি’ বলা ফটোগ্রাফারদের অনেকটাই এখন জীবিকার প্রয়োজনে খুঁজে নিয়েছে উপার্জনের ভিন্ন পথ। তবে কেউ কেই বলছে শহরে বেশ কয়েকটি উন্নত ল্যাব হওয়া মানুষ স্মার্টফোনে তোলা সেলফিগুলো সেখানেই অল্প টকায় প্রিন্ট করতে পারছে।

এর ফলে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে ড্রাকরুম, নেগেটিভ, ফিল্ম ডেভেলপ করা এবং ছবি পজিটিভ করার পুরাতন রীতি।

চাঁদপুর শহরের বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব স্টুডিওগুলোর মধ্যে স্টুডিও মিলন, ইলোরা, আনন্দ, মনিহার (১), মনিহার (২), ছায়াবিথী, একা, মৌ অন্যতম। এছাড়া বর্তমানে শহরের যে কয়েকটি স্টুডিও এখনো টিকে আছে তার মধ্যে রয়েছে স্টুডিও শাপলা, দোয়েল, কনিকা, পল্লবি, মায়া, পুরাণবাজারে শিমুল, মেঘনা, বাঁধন।

ইংরেজি শব্দ সেলফিশ থেকে সেলফি’র অবির্ভাব। অক্সফোর্ড অভিধানের মতে সেলফি শব্দের অর্থ প্রতিকৃতি। সেলফি হল এমন একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি।

সেলফি সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামেরায় ধারণ করে ফেসবুক, ইমো, ম্যাসেঞ্জার, হোয়ার্টসএ্যাপ, ভাইবার, গুগল+, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আপলোড করা হয়ে থাকে। শহরের বিভিন্ন অলিগলি ঘুড়ে দেখা যায়, চলন্ত গাড়ি, রাস্তা-ঘাটে, ঘরে কিংবা বিপণী বিতানে দাঁড়িয়ে শিশু-কিশোর থেকে মধ্যবয়সীরাও স্মার্টফোন দিয়ে ‘সেলফি’ তুলছেন।

এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডিএসএলার ক্যামেরা হাতে অনেক তরুণ-তরুণীদের দেখা যাচ্ছে। এরা প্রতিদিন শত শত ছবি তুলে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করছে প্রয়োজনে আবার ল্যাব থেকে ইচ্ছামতো সাজিয়ে প্রিণ্ট করে নিচ্ছে। এতে সহযোগিতা লাগছে না কোনো পেশাগত ফটোগ্রাফার কিংবা স্টুডিওর।

তাদের আপলোড করা ছবিগুলো মুহূর্তেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ পরিচিতিজনরা পেয়ে যাচ্ছে। সে ছবি দেখে বন্ধুদের যে যার মতো লাইক (পছন্দ) কমেন্ট (মন্তব্য) করে নিচ্ছে। আবার সে ছবি একে অন্যকে শেয়ার করছে। ফলে শহরের স্টুডিও মালিক ও কর্মীদের মাঝে এখন দেখা দিয়েছে হতাশা আর অনিশ্চয়তা। অনেকই আবার অন্যকাজ জানা না থাকায় নানা অনিশ্চয়তা আর টানাপড়নে মধ্যে থেকেও শখের এই ব্যবসা ছাড়তে পারছেন না।

শহরের সুনামধন্য স্টুডিও দোয়েলের মালিক নিরঞ্জন সিংহ রায় (বাচ্চু) জানান, স্টুডিও শাপলা’র মালিক খোকন চন্দ্রের কাছেই তিনি ফটোগ্রাফি শিখেছেন। এর আগে সর্ব প্রথম স্টুডিও শাহীনে বন্ধু তপন দে-এর কাছে কিছুদিন কাজ করেছেন। এরপরে ১৯৯৮ সালে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন স্টুডিও দোয়েল। ওই সময়টা ছিলো স্টুডিও ব্যবসার স্বর্ণযুগ। তখনকার সময়ে মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়াও সখের বসে স্টুডিওতে ছবি তুলতে আসতো।

বিশেষ দিনগুলো যেমন ঈদ, পূজা, বিয়ে, বৈশাখসহ বিভিন্ন উৎসবে অনেকেই দলবেঁধে ছবি তুলতো। বর্তমানে এসব অতিত শুধুই স্মৃতি। এখন ফটো স্টুডিওগুলোতে মানুষরা শুধুমাত্র পাসপোর্ট, ভিসাসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের ছবি তোলার জন্য আসেন। শুধুমাত্র সেলফি আগ্রাসনে অনেক স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেছে। বাকীগুলো এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

পুরোনো এ ব্যবসায়ী আরো জানান, ‘আগে আমরা হাতে কাজ করতাম। কিন্তু এখন কম্পিউটারে কাজ করছি। এতে ছবি চকচকে ঝকঝকে হচ্ছে তবে, ন্যাচারালিটি (সমদর্শিতা) থাকছে না। এখন আর ড্রাকরুম নেই। নেগেটিভ, ফিল্ম ডেভেলপ এসব মানুষ ভুলেই গেছে। আগে আমাদের কাছে নেগেটিভ রিজার্ভ থাকতো। তাই দ্বিতীয়বার ওই ছবি প্রিন্ট করতে হলে আমাদের কাছেই আসতে হতো। কিন্তু এখন আর ছবির রি-অর্ডার আসে না। কারণ সবাই তার মোবাইলে ছবি রিজার্ভ করে রাখে। বর্তমানে একজন ভাল এডিটর আর ফটোগ্রাফার থাকলেই হলো। এখন একাই অনেক কাজ করা যাচ্ছে।’

এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ অনুজ্জ¦ল দাবি করে এ ব্যবসায় তার ছেলেকে জড়াবেনা বলে জানান নিরঞ্জন সিংহ রায়।’

চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারের পুরোনো ‘স্টুডিও শিমুল’-এর ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, স্টুডিওটির দেয়ালে এখনো রং তুলিতে হাতের আলপনা ফুল, লতা- পাতা নদী-নৌকার চিত্র শোভা পাচ্ছে। এছাড়া একপাশে ঘরের কৃত্রিম বারান্দার অবকাঠামো সাঁজানো। রয়েছে কৃত্রিম সিঁড়ি। কিন্তু ছবির কারুকার্যের সাথে এ অবস্থার কোনো মিল নেই।

শিমুল স্টুডিও’র মালিক গৌতম পাল চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘আগে স্টুডিওতে ছবি তুলতে আসা মানুষরা হাতে আলপনা করা এসব চিত্রের এবং কৃত্রিম ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েই ছবি তুলতেই বেশি পছন্দ করতো। বর্তমান ডিজিটাল ব্যবস্থা আসার পর এসব ব্যাকগ্রাউন্ড (ছবির পেছনের দৃশ্য) খুব একটা কাজে লাগে না। এখন প্রযুক্তির যুগ তাই ইন্টারনেট থেকে থেকে যে কোনো দৃশ্য নামিয়ে ছবিতে জুড়ে দেয়া যায়। ফলে দেয়ালে আঁকা এসব দৃশ্যের কদর একেবারেই কমে গেছে।’

অনেকটা হতাশার কণ্ঠে তিনি জানান, ‘আমাদের ৮০/৯০ হাজার টাকায় ক্রয় করা দামি দামি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বর্তমানে আমরা যারা এই শীল্পের সাথে জড়িত আছি তারা খুবই খারাপ সময় পার করছি। শহরের যে ক’টা স্টুডিও ভালো অবস্থায় রয়েছে তাদের অধিকাংশ ছবি তোলার পাশা-পাশি ভিডিও প্রেগ্রামিং-এর ব্যবসা করছে।’

স্টুডিও দোয়েলে গিয়ে দেখা যায়, ফটোগ্রাফার সঞ্জিত ও তুশার একাধারে ছবি তুলছে এবং ওই ছবি কম্পিউটারে এ্যাডিটিংয়ের কাজও করছেন। অর্থাৎ নতুন ছবি না তুলে একটি ছবি দিয়ে একাধিক ছবি তৈরি করছেন।

ফটোগ্রাফার সঞ্জিত চাঁদপুর টাইমসকে জানায়, ‘স্টুডিওতে এখন যারা আসেন তারা বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের জন্যই ছবি তুলতে কিংবা প্রিন্ট করতে আসেন। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, ভিসার আবেদনকারী ও চাকরি প্রার্থীরা পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলতে আসে। কিন্তু চাঁদপুরে আধুনিক ল্যাব থাকায় অনেকই বাইরের মোবাইলে বা ক্যামেরায় তোলা ছবি প্রিন্ট করতে আমাদের কাছে আসেন না, ল্যাবে চলে যান।’

এক সময়ে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা নাট্যকর্মী জসিম মেহেদী চাঁদপুর টাইমসকে জানায়, ‘আগে আমরা বন্ধু কিংবা পরিবারের কাউকে নিয়ে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলতাম। সেসব ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকতো নানা ধরনের প্রাকৃিতক দৃশ্য। কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও এমন স্টুডিও খুঁজে পাওয়া যায় না। এখনকার স্টুডিওগুলোর সাজসজ্জা ও কাজের পরিবর্তন হয়েছে। একসময়কার প্রচলিত অনুষঙ্গ যেমন, ফিল্ম, নেগেটিভ, ড্রাকরুম ফটোগ্রাফির এখন আর প্রয়োজন হয়না। তাই সেলফির এই যুগে স্টুডিও ব্যবসায়ীরা আমার কাছে মনে হয় তেমন ভালো নেই।’
আশিক বিন রহিম, চীফ করেসপন্ডেন্ট
: আপডেট ৬:৩৬ পিএম, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ