Home / জাতীয় / ‘সু চি ও সেনাবাহিনীর বিচার করতে হবে’
hasina

‘সু চি ও সেনাবাহিনীর বিচার করতে হবে’

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো নৃশংসতাকে গণহত্যা অভিহিত করে তিন নারী নোবেল বিজয়ী বলেছেন, এ নৃশংসতার জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে তাঁরা এ কথা বলেন। আয়ারল্যান্ডের মেরেইড ম্যাগুয়ার, ইরানের শিরিন এবাদি ও ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো বর্বরতার বর্ণনা তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সু চিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচারের মুখোমুখি করব। শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চিকে হুঁশিয়ার করে তাঁরা বলেছেন, হয় তাঁকে গণহত্যার দায়ে পদত্যাগ করতে হবে, না হয় আইসিসিতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

বাসস জানায়, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিন নোবেলজয়ীর বৈঠকের পর এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম। তিনি জানান, নোবেল বিজয়ীরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, জাতিগত নিধনযজ্ঞ মিয়ানমার সরকারের একটি পদ্ধতিগত নীতি। বিশ্ব কিছুতেই এ নিয়ে নীরব থাকতে পারে না।’ তাঁরা মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দয়ালু মা’ অভিহিত করে তাঁরা বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের এখন বেশি করে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৭ সাল থেকে কিভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে শুরু করে, তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। ‘বাংলাদেশ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। আমরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছি।’

তিন নোবেল বিজয়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তিন দিন তিন রাত নারী ও শিশুদের মুখে শোনা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে মারা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন। এ হত্যাযজ্ঞের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্টেট কাউন্সেলর সু চিকে দায়ী করে তাঁরা বলেছেন, এদের আইসিসিতে বিচার হওয়া উচিত। গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া চীন ও ভারতের নৈতিক দায়িত্ব বলেও মনে করেন তাঁরা।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও কিভাবে আইসিসিতে বিচার করা সম্ভব হবে, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে আইন বিষয়ে দক্ষ শিরিন এবাদি বলেছেন, ‘সুদানেও চীনের অর্থনৈতিক সুবিধা ছিল। মিয়ানমারেও আছে। চীন ভেটো দিতে পারে। তারও সমাধান আছে। সুদানে গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার হয়েছে। সু চি ও তাঁর দেশের সেনাবাহিনীর বিচারও সম্ভব হবে।’

ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বিষয়ে ক্যাম্পে যাওয়ার আগে যা শুনেছি, বাস্তবে পরিস্থিতি তার চেয়েও নৃশংস। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই মিয়ানামার সেনাবাহিনী দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। সব শিশুই তাদের পরিবারের আপনজনদের হারিয়েছে। কেউ হারিয়েছে বাবাকে। কেউ হারিয়েছে মা-বাবা, ভাই-বোনকে।’ তিনি বলেন, ‘এই অপরাধ তো বিশ্ব মেনে নিতে পারে না।’ শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চির প্রতি ধিক্কার জানিয়ে কারমান বলেন, ‘সু চি নীরব রয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের সময় তাঁর নীরবতাও এক ধরনের অপরাধ। সরকারপ্রধান হিসেবে দেশের সব নাগরিকের সব অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব তাঁর। এ ঘটনায় তাঁর দায় আছে। তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।’

‘সু চি, আপনি দয়া করে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন। রোহিঙ্গাদেরও অন্যদের মতো সমান অধিকার দিন। না হলে পদত্যাগ করুন। অথবা বিচারের মুখোমুখি হন’—চোখ ভিজিয়ে, দুই হাত নাড়িয়ে, চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলছিলেন কারমান।

শিরিন এবাদি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এবারই প্রথম নয়। বহুবছর ধরে হয়েছে। তবে এবার যেটা করা হয়েছে, তা পুরোপুরি গণহত্যা। দুর্ভাগ্য যে পশ্চিমের দেশগুলোতে ইসলামভীতি আছে। তারা কোথাও কিছু ঘটলে মুসলিমদেরই দায়ী করে; কিন্তু এখানে মুসলমান রোহিঙ্গারা করুণ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। সু চিও এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।

রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, ‘ইরান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন রোহিঙ্গাদের পাশে নেই? মুসলমানরা একত্রিত হলে এই সংকটের দ্রুত সমাধান নিশ্চিত। যথেষ্ট হয়েছে, এখন সময় নীরবতা ভেঙে ব্যবস্থা নেওয়ার।’

মেরেইড ম্যাগুয়ার বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের কারো স্বামীকে মেরে ফেলা হয়েছে, ছয় মাসের সন্তানকে পুড়ে ফেলা হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। এটা পুরো মানবজাতির কাছেই গণহত্যা। এসব অপরাধ করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর দেশটির সরকারের নীতি সেনাবাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে সমর্থন জুগিয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সামরিকভাবে ও অস্ত্র দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। চীন ও ভারতের নৈতিক দায়িত্ব হলো, এই ক্ষেত্রে মানবতার পক্ষ নেওয়া, গণহত্যাকারী মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া।’

নোবেল বিজয়ীরা বলেন, রোম সনদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু বাংলাদেশই এই সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমারও এতে অনুস্বাক্ষর করেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের উচিত, রোহিঙ্গা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য একটি মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে পাঠানো। বিকল্পভাবে, আইসিসির প্রসিকিউটর স্বাধীনভাবে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার তদন্ত করতে পারে। মিয়ানমারের ওপর সমন্বিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে, যাতে কোনো দেশই তাদের কাছে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি না করে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে কারমান বলেন, ‘আমাদের মিয়ানমার যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের সময় থেকেই আমরা সু চিকে অনেক বার্তা পাঠিয়েছি। তবে দুর্ভাগ্য যে তিনি আমাদের কোনো বার্তারই জবাব দেননি।’ সংবাদ সম্মেলনে নোবেল উইম্যানস ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এলিজাবেথ বার্নস্টেইন ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন পারভীন হক উপস্থিত ছিলেন। এই তিন নোবেলজয়ী আগামীকাল ঢাকা ছেড়ে যাবেন।

(কালের কন্ঠ)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১০: ৪০ এ.এম ১মার্চ ২০১৮বৃহস্পতিবার।
এএস.