দুই দিন ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের জলপাইতলি এলাকায় ত্রিপল টানিয়ে থাকছে কয়েক শ রোহিঙ্গা। তাদের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ওই রোহিঙ্গাদের ঘিরে রেখেছেন। তবে তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে শনিবার রাত থেকে গতকাল রোববার ভোর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ঢুকেছে। উখিয়ার অনিবন্ধিত বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের (ক্যাম্প) সভাপতি মোহাম্মদ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাতে শুধু তাঁদের শিবিরেই মিয়ানমার থেকে নতুন
করে আসা ১০০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় হাজারো রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে। সুযোগ পেলে তারা বাংলাদেশে ঢুকবে। তিনি বলেন, গতকাল দুপুরে উখিয়ার পানবাজার এলাকায় অন্তত ৩০০ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ ও বিজিবি। তাদের হয়তো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
এদিকে গুলিবিদ্ধ আরও চার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের মধ্যে এক শিশু ও এক কিশোর রয়েছে। গতকাল ভোরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় তারা। এ নিয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ। এর আগে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গুলিবিদ্ধ দুই রোহিঙ্গার একজন মারা যায়।
গতকাল ভর্তি হওয়া চারজন হলেন মো. ইদ্রিস (১০), মো. তোহা (১৬), মো. ইলিয়াস (২০) ও মো. জিয়াবুল (২৭)। তোহার গলায় এবং অন্যদের মাথায় গুলি লেগেছে। শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের মংডুর সাহেব বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁরা গুলিবিদ্ধ হন। এরপর শনিবার ভোরে সীমান্ত পেরিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুবপালং রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁরা আশ্রয় নেন।
আহত ইদ্রিসের বাবা মো. রশিদ বলেন, শুক্রবার রাত নয়টায় গুলি চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গুলিবিদ্ধ ছেলেকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করলেও তাঁর স্ত্রী এবং বাকি চার সন্তান মিয়ানমারে।
সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন গতকাল দুপুরে ঘুনধুম ও তুমব্রু এলাকায় যান। ঘুনধুম সীমান্তচৌকিতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে বিশ্বাসী। সীমান্তে সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছে। এতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। মিয়ানমারের যে সমস্যা তা কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সমাধান করা জরুরি। মিয়ানমারের উচিত তার দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া।
বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতিতে কোনো গোলা-বারুদ বাংলাদেশের ভেতরে পড়েনি। যদি আঘাত আসে তাহলে এর উচিত জবাব দেওয়া হবে। মিয়ানমারের কোনো নাগরিককে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তের পাহারা আরও জোরদার করা হয়েছে।
বিজিবির মহাপরিচালক ঘুনধুম থেকে তুমব্রু সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়নের অধিনায়ক কর্নেল আনিসুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।
ঘুনধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত শনিবার ঘুনধুম সীমান্তের ওপারে ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। ভয়ে রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও বয়স্ক লোকজন সীমান্তের দিকে ছুটে আসতে থাকে।
তবে ঘুনধুম সীমান্তে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা পরিস্থিতি শান্ত হলে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাবে বলে জানান সেখানকার বিজিবির কর্মকর্তারা।
গতকাল ভোরে নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে ঢোকেন রোহিঙ্গা নারী লায়লা বেগম। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর ফাতংজা গ্রামে। একমাত্র শিশুকন্যা নুর নাহারকে নিয়ে তিনি দুপুরে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তির নূর আহমদের ঘরে আশ্রয় নেন।
লায়লা বেগম বলেন, মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা তাঁদের গ্রামে ঢুকেই গুলি করতে থাকে। তখন তাঁর স্বামী আমির হোসেন বাড়িতে ছিলেন না। তিনি প্রাণভয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘর ছাড়েন। তাঁর স্বামী কোথায় আছেন, তিনি জানেন না।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ থেকে ৯১ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের,শনিবার রাত নয়টার দিকে নারী-শিশুসহ ৭১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে রাত একটার দিকে উখিয়া সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বলেন, গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে টেকনাফের দমদমিয়া ও শাহপরীর দ্বীপ এলাকা থেকে ২০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেন তাঁরা। পরে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।
(প্রথম আলো)