রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের বার্তা নিয়ে মুমিনের দরজায় কড়া নাড়ছে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। আগামী মঙ্গলবার ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় আকাশে রমজানের চাঁদ দেখা গেলে ১৪ এপ্রিল বুধবার থেকে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সিয়াম সাধনা শুরু করবেন।
রাতে তারাবির নামাজ পড়া এবং শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে মাহে রমজানের আনুষ্ঠানিকতা। রমজানের মাসআলা-মাসায়িল, ফজিলত ও তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- ড. সৈয়দ রেজওয়ান আহমদ
রোজা
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম রোজা। ইমান, নামাজ ও জাকাতের পরই রোজার স্থান। আরবি ভাষায় রোজাকে ‘সাওম’ বলা হয়। যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা।
শরিয়তের পরিভাষায় সাওম বলা হয় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী কাজ থেকে বিরত থাকাকে।
সুতরাং রমজানের চাঁদ উদিত হলে প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ওপর পূর্ণ রমজানের রোজা রাখা ফরজ। আল্লাহ বলেন- ‘হে ইমানদারগণ তোমাদের ওপর (রমজানের) রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)।
নবী কারিম (সা.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবেকদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে তারও পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি শরিফ ১/২৫৫, মুসলিম শরিফ ১/২৫৯, মেশকাত শরিফ ১/১৭৩)।
রোজার ফজিলত
মহানবী সা. বলেন- ‘রোজার প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই দেবেন এবং বিনা হিসাবে দেবেন।’ [বুখারি শরিফ হাদিস ১৮৯৪]। আল্লাহতায়ালা রোজাদারকে কেয়ামতের দিন পানি পান করাবেন। [মুসনাদে বাযযার হাদিস : ১০৩৯]। ‘রোজা হলো জান্নাত লাভের পথ’। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৩৩২৪]।
‘রোজা জাহান্নাম হতে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ’। [মুসনাদে আহমদ হাদিস, ১৪৬৬৯]। ‘রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত। [বুখারি হাদিস-১৯০৪]। রোজাদারের দুটি আনন্দঘন মুহূর্ত। ১. ইফতারের সময় ২. যখন সে তার রবের সঙ্গে মিলিত হবে। [বুখারি হাদিস ১৯০৪]।
এ ছাড়া আরও অনেক হাদিসে রোজার বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।
রমজান মাসের উত্তম আমল
১. সূর্য ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। ২. খেজুর দ্বারা ইফতার করা, না থাকলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। ৩. যে জিনিসের মাধ্যমে ইফতার করবে তা বিজোড় হওয়া। ৪. ইফতার করার সময় কুরআন-সুন্নাহ থেকে বর্ণিত দোয়া পড়া। যেমন : আল্লাহুম্মাগফিরলি ওয়ারহামনি। ৫. সেহরির সময় অল্প করে হলেও কিছু খাওয়া। ৬. সেহরি এত দেরিতে না করা যে, সুবহে সাদিক হওয়ার আশঙ্কা হয়। ৭. সব ধরনের অনর্থক কথাবার্তা থেকে জবানকে হেফাজত করা এবং সব ধরনের হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন গিবত, চোখলখোরি, মিথ্যা বলা ইত্যাদি। ৮. আত্মীয়স্বজন, মুখাপেক্ষী, এতিম, গরিব, মিসকিনকে দান-সদকা করা। ৯. ইলম অর্জনে লিপ্ত থাকা, কুরআন মাজিদের তিলাওয়াত করা, দরুদ শরিফ পড়া, ইস্তিগফার করা, জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের জন্য দোয়া করতে থাকা। সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকা। ১০. ইতিকাফ করা। [মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা ২৮/২৮-২৯]।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না
ভুল করে কোনো কিছু খেয়ে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে না [বুখারি শরিফ ১/২৫৯]। মশা-মাছি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙবে না [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৪৯]। অনিচ্ছাকৃত বমি হলে [এমনকি মুখ ভরে হলেও] রোজা ভাঙবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোজা ভাঙবে না [তিরমিযী ১/১৫৩]। রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে রোজা নষ্ট হবে না। তবে রোজা স্মরণ হওয়ামাত্র পানাহার ছেড়ে দিতে হবে [মুসলিম ১/২০২]। দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে পেটের মধ্যে না গেলে রোজা ভাঙবে না [শামী ৩/৩৬৭]। কোনো খাদ্যদ্রব্য বুট বা ছোট ছোলার কম পরিমাণ যদি দাঁতের সঙ্গে লেগে থাকে ও গলার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোজা ভাঙবে না [হিন্দিয়া ১/২০২]। হ্যাঁ, দাঁত থেকে বের করে হাতে নিয়ে স্বেচ্ছায় খেয়ে ফেললে রোজা নিশ্চিতভাবে ভেঙে যাবে [হিন্দিয়া ১/২০২]। অতিরিক্ত গরম বা পিপাসার কারণে যদি গোসলের মাধ্যমে শরীরকে ঠান্ডা করে তাহলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। কুলি করার পর পানির অবশিষ্ট আর্দ্রতা থুথুর সঙ্গে গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। ঘাম অথবা চোখের অশ্রুর দু-এক ফোঁটা যদি অনিচ্ছায় মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। কানের ময়লা বাইর করার দ্বারাও রোজা ভাঙবে না [মারাকিল ফালাহ ৩৪২]। যদি পান খাওয়ার পরে খুব ভালোভাবে কুলি করার পরও রোজা অবস্থায় থুথুর সঙ্গে লাল রং বের হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই [হিন্দিয়া ১/২০৩]। নাক এত জোরে সাফ করা, যার ফলে কফ গলার মধ্যে চলে যায়, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই [দুররে মুখতার ৩/৩৭৩]। রোজা অবস্থায় আতর বা ফুলের ঘ্রাণ নিলেও কোনো সমস্যা নেই [মারাকিল ফালাহ, ৩৬১]। শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না, বরং তা বৈধ [মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৪/৩১৩]। রোজা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত মুখের মধ্যে ধুলাবালি ঢুকে গেলে রোজা ভাঙবে না [দুররে মুখতার ৩/৩৬৬]। যদি রোজাদারের গোসল করার সময় অথবা বৃষ্টিতে ভেজার সময় কানের মধ্যে অনিচ্ছায় পানি চলে যায়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে রোজা নষ্ট হবে না [ফাতহুল কাদীর ২/৩৪৭]। সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [সুনানে কুবরা বায়হাকি ৪/২৩৫]।
রোজা ভঙ্গের কারণগুলো
রোজা অবস্থায় অসুস্থতার কারণে ইনহেলার (Inhelar) ব্যবহারের দ্বারা রোজা ভেঙে যায় [শামী ৩/৩৬৬]। রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত বমি করা, বা মুখে বমি চলে আসার পর তা পরিমাণে অল্প হলেও ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে [মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৪/১৯৭]। যদি নাশিকা দিয়ে রক্ত বের হওয়ার পর মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [তাতারখানিয়া ৩/৩৮৩]। রোজাদার যদি মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর এমতাবস্থায় সুবহে সাদিক হয়ে যায় ও পানের কিছু অংশ পেটে চলে যায়, তাহলে তার রোজা হবে না। পরে কাজা করতে হবে। হ্যাঁ, কাফফারা দেওয়া লাগবে না [শামী ৩/৩৭৪]। কুলি করার সময় যদি অনিচ্ছাকৃত পানি গলা দিয়ে পেটে চলে যায় তাহলে রোজা কাজা করতে হবে। কাফফারা ওয়াজিব হবে না। আর যদি রোজার কথা স্মরণই না থাকে, পানি মুখে নিয়ে খেয়ে ফেলে তাহলে রোজা ভাঙবে না [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৮]। নাক অথবা কানের মধ্যে তৈল দেওয়ার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না [হেদায়া ১/২২০]। যদি কোনো ব্যক্তি কারও ধমকের কারণে অথবা ভুল করে যেমন রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করে অতঃপর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছা করে পানাহার করল, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাজা করা জরুরি [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯]। পাথরের কণা, মাটি, ঘাস, কাগজ ইত্যাদি মোটকথা যা সাধারণ আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না তা খেলেও রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা করতে হবে [বাযযাযিয়া, ৪/৯৯]। দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি থুথুর সঙ্গে ভেতরে চলে যায়। আর রক্তের পরিমাণ যদি থুথুর সমান বা বেশি হয় তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [বুখারী ১/২৬০]। বিড়ি সিগারেট, হুঁকা পান করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা করা জরুরি [শামী৩/৩৬৬]। কঠিন অসুস্থতার ফলে যদি কোনো মানুষ রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৮৯]। যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত রোজা ভেঙে ফেলে অতঃপর খুব অসুস্থ হয়ে যায় অথবা কোনো নারীর প্রিয়ড হয়, তাহলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [হিন্দিয়া ১/২০৬]। রোজা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে তার স্বামী জোর করে সহবাস করলে স্ত্রীকে শুধু কাযা আদায় করতে হবে। কাফফারা নয় [তাতারখানিয়া ৩/৩৯৪]। যদি কোনো ব্যক্তি রোজা অবস্থায় সফর করে তার জন্য কোনো ওজর ছাড়া রোজা ভেঙে ফেলা অনুচিত। যদি ভেঙে ফেলে তাহলে শুধু কাজা জরুরি, কাফফারা নয় [আলমগিরী ১/২০৬]। যদি কোনো পুরুষের প্রস্রাবের রাস্তায় কোনো ওষুধ দেওয়া হয় আর অণ্ডকোষ পর্যন্ত পৌঁছে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে অন্যথায় নয় [তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৮৩]। কোন নারীর লজ্জাস্থানে ওষুধ লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই রোজা ভেঙে যাবে [বাহরুর রায়েক ২/৪৮৮]।
রোজার আধুনিক কিছু মাসআলা
চোখে ওষুধ, ড্রপ বা সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। [আবু দাউদ-১/৩৩২]। রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের করে টেস্ট বা পরীক্ষা করালে রোজা ভঙ্গ হয় না। [আলমগিরী ১/১৯৯]। হৃৎপিণ্ডের অসুস্থতার ফলে যে ওষুধ জিহ্বার নিচে রাখা হয় তার দ্বারা রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তা বিগলিত হয়ে থুথুর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে গলা বা পেটের মধ্যে ঢুকে গেলে রোজা ভেঙে যাবে [শামী ৩/৩৬৭]। যদি রোজা অবস্থায় এমন ইঞ্জেকশন গ্রহণ করে যা পেটের মধ্যে অথবা মস্তিষ্কের মধ্যে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [জাওরাহিরুল ফিকহ ১/৩৭৯]। শরীরে স্যালাইন লাগানোর দ্বারা রোজা নষ্ট হবে না। তবে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেওয়া অনুচিত [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯]। ডায়ালাইসিস করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯]। রোজা অবস্থায় অক্সিজেন নেওয়ার দ্বারা রোজা নষ্ট হয় না [আয়েনায়ে রমজান ৬৫]। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ঘ্রাণ নেওয়ার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয় না [মারাকিল ফালাহ ৫৪৩, আয়েনায়ে রমজান ৭১]। যদি পেট পরীক্ষা বা টেস্টের জন্য পেটের মধ্যে নাক বা গলা দিয়ে কোনো নল প্রবেশ করানো হয় আর তার মধ্যে কোনো ওষুধ মিশ্রিত করা হয়, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে [মুফতিরাতিস সিয়ামুল মুআ’সারাহ ৪৫-৫২]।
রোজা অবস্থায় করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করা যাবে
করোনাভাইরাসের টিকা মাংসপেশিতে গ্রহণ করা হয় এবং তা সরাসরি খাদ্যনালি ও পাকস্থলীতে প্রবেশ করে না, সেহেতু রমজান মাসে রোজাদার দিনের বেলায় শরীরে করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হবে না। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
সেহরি
সেহরি খাওয়া সুন্নাত। যদি কোনো ব্যক্তি সেহরি খাওয়া ছাড়াই রোজার নিয়ত করে নেয়, তথাপিও তার রোজা হয়ে যাবে। তবে সে সেহরির বরকত পাবে না। [শামী ৩/৪০০]। সেহরি করা বরকতময়। [বুখারি শরিফ, ১/২৫৭]। সেহরি দেরিতে করা মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা কাম্য নয় যে, সময়ের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যায়। যা মাকরুহ। [হেদায়া ১/২২৫ মারাকিল ফালাহ ৩৭৩]।
ইফতার
ইফতারের সময় হয়ে গেলে দ্রুত ইফতার করা সুন্নাত। অনর্থক দেরি করা অপছন্দনীয়। [বুখারি শরিফ-১/২৬৩]।
কাঁচা বা শুকনা খেজুর দ্বারা ইফতার করা উত্তম। যদি সম্ভব না হয় তাহলে পানি দ্বারা ইফতার করা ভালো। [তিরমিযি ১/১৪৯]।
রমজানের গুরুত্ব
হজরত সালমান ফার্সি (রা.) বর্ণনা করেন, শাবান মাসের শেষ দিনে নবী কারিম (সা.) মিম্বরে বসে বলেন- হে লোকজন! তোমাদের ওপর এক মহা ও বরকতময় মাস আগত প্রায়। এমন মাস, যার মধ্যে এমন একটি রাত (শবেকদর) আছে যা হাজার মাস থেকে উত্তম। (অর্থাৎ ওই এক রাতের ইবাদতের সওয়াব হাজার মাসের থেকে বেশি) আল্লাহতায়ালা এ মাসে দিনেরবেলা রোজা ফরজ করেছেন আর রাতে ইবাদতকে করেছেন নফল। এ মাসে যে ব্যক্তি নেক আমলের দ্বারা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জনের প্রত্যাশী হবে, তার অবস্থা এরূপ যে কেমন যেন সে অন্য মাসে ফরজ আদায় করেছে। অর্থাৎ নফলের সওয়াব ফরজের সমতুল্য হবে। আর যে ব্যক্তি এ মোবারক মাসে কোনো ফরজ আদায় করবে তার অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সাওয়াব হবে।
অর্থাৎ রমজানে এক ফরজের সাওয়াব সত্তর গুণ বেড়ে যায়। রমজান সবরের মাস, আর সবরের সাওয়াব ও বদলা হলো জান্নাত। এ মাস মানুষের সঙ্গে সদাচার ও কল্যাণকামিতার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা মিলবে। সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের সওয়াব কম করা ছাড়াই ইফতার করানো ব্যক্তি রোজার অনুরূপ সাওয়াব লাভ করবে। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সা.) আমাদের মধ্যে অনেক মানুষ এমন রয়েছে, যাদের এ সামর্থ্য নেই যে, তারা অন্যকে ইফতার করাবে, আর এমন সওয়াব লাভ করবে।
এ প্রশ্ন শুনে নবী কারিম (সা.) এমন জওয়াব দিলেন যা শুনে তাদের হতাশা ও কষ্টগুলো আশা এবং আনন্দে পরিণত হলো। তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালা এসব পুরস্কার ওইসব ব্যক্তিদেরও দেবেন, যারা কোনো রোজাদারকে এক ঢোক দুধ, একটি খেজুর, এমনকি এক ঢোক পানি পান করাবে। তবে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহতায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন আমার হাউজে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন যে তারপর চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশের আগে তার আর পিপাসা লাগবে না। এরপর নবী কারিম (সা.) বলেন, রমজান এমন মাস, যার প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত আর শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির দশক। যে ব্যক্তি এ মাসে তার গোলাম (কর্মচারী, চাকর, এক কথায় অধীনস্থ প্রত্যেক ব্যক্তি) থেকে কাজের বোঝা বা দায়িত্ব হালকা করে দেবে আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।
হে লোকজন! এ মাসে চারটি জিনিসের ওপর খুব গুরুত্ব দাও এবং বেশি বেশি করে কর। ১. কালিমা তাইয়্যেবা-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু। ২. ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা। ৩. জান্নাত চাওয়া। ৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করা। (মেশকাত শরিফ : ১/১৭৪, বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান ৩/৩০৫)।
রমজানের ইতিহাস
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের ওপর রোজা ফরজ হয় ২য় হিজরিতে। অবশ্য আগের উম্মতের ওপরও রোজার বিধান ছিল। যার বর্ণনা রয়েছে সূরা বাকারার ১৮৩নং আয়াতে। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী হজরত আদম (আ.) থেকে নিয়ে হজরত নূহ (আ.) পর্যন্ত প্রত্যেক উম্মতের ওপর চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা পালনের হুকুম ছিল। ইহুদিরা প্রতি সপ্তাহে শনিবার আর মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা পালন করত। মূসা (আ.)-এর তুর পাহাড়ে অবস্থানের স্মৃতিচারণে তাদের জন্য ৪০ দিন রোজা রাখার বিধান ছিল।
নাসারা তথা খ্রিষ্টানদের ৫০ দিন রোজা পালনের রেওয়াজ ছিল। জানা যায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও একাদশী উপবাস পালন করে থাকেন। পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোয় রোজাকে নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাওরাতে রমজানকে বলা হয়েছে ‘হাত’ অর্থাৎ গুনাহ ধ্বংসকারী। যাবুরে বলা হয়েছে ‘কুরবাত’ অর্থাৎ নৈকট্য লাভ করা। কেননা রোজার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকে। আর ইঞ্জিলে একে ‘ত্বব’ বলা হয়েছে। যার অর্থ পবিত্র হওয়া। আর পবিত্র কুরআন মাজিদে একে বলা হয়েছে ‘রামাদান’ যার অর্থ হলো দাহ, উত্তাপ, দহন, সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত মাটি ইত্যাদি।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়
রোজা অবস্থায় মুখের মধ্যে থুথু জমা করা [হিন্দিয়া ১/১৯১]। বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া বা চিবানো (শামী ৩/৩৯৫)। টুথপেস্ট অথবা কোনো মাজন দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা (শামী ৩/৩৯৫)। প্রত্যেক ভারী কাজ যার ফলে রোজা ভেঙে ফেলার উপক্রম হয় [দুররে মুখতার ৩/৪০০]। রোজা অবস্থায় গুনাহের কাজ করা [তিরমিযি ১/১৫০]। কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার সময় অতিরঞ্জন করা [হিন্দিয়া ১/১৯৯]। সন্দেহযুক্ত সময়ে সেহরি করা [হিন্দিয়া ১/২০০]। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোজা রাখা [হিন্দিয়া ১/২০১]। রোজা অবস্থায় লিপস্টিক দেওয়া মাকরুহ। কেননা তা মুখের মধ্যে চলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তবে মাথায় মেহেদি লাগানোতে কোনো সমস্যা নেই (তাতারখানিয়া ৩/৩৯৫)।
তারাবিহ
তারাবিহ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম নেওয়া। হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, রমজানের রাতে জামাতসহকারে যে নামাজ আদায় করা হয় তার নাম তারাবিহ রাখা হয়েছে এ জন্য যে, যখন সাহাবায়ে কেরাম এ নামাজের জন্য একত্রিত হতেন তখন তারা দুই সালাম অর্থাৎ চার রাকাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। আর এ জন্যই এ নামাজের নাম রাখা হয় তারাবিহ [ফাতহুল বারী ৪/৩১৪]।
রমজানুল মোবারকে এশার নামাজের পর বিশ রাকাত তারাবিহ দশ সালামের সঙ্গে আদায় করা পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ [দুররে মুখতার ২/৪২৯]।
ইতিকাফ
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত শবেকদর। প্রত্যেক মুমিনের উচিত এ রাতে ইবাদত বন্দেগি করে খোদার সন্তুষ্টি অর্জন করা। যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা শবেকদরের সন্ধানে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।
হজরত উমর (রা.) বর্ণনা করেন- নবী কারিম (সা.) রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন ( বুখারি, মুসলিম)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন- আল্লাহর রাসূল (সা.) রমজানের মধ্যের দশকে ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ করছিলেন- যখন একুশের রাত এলো, যে রাতের সকালে তিনি তার ইতিকাফ থেকে বের হবেন, তখন তিনি বললেন- যারা আমার সঙ্গে ইতিকাফ করেছে, তারা যেন শেষ দশকেও ইতিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এ রাত (শবেকদর) দেখানো হয়েছিল, পরে আমাকে তা (সঠিক তারিখ) ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ওই রাতের সকালে আমি কাদাপানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বিজোড় রাতে তালাশ কর। পরে এ রাতে আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কপালে কাদাপানির চিহ্ন আমার এ দু’চোখ দেখতে পায় [বুখারি শরীফ]। এজন্য প্রত্যেক শবেকদর তালাশকারীর উচিত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা।
ইতিকাফের পরিচয়
ইতিকাফ শব্দের অর্থ- অবস্থান করা, আটকে রাখা। শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়- ইতিকাফের নিয়তে পুরুষের এমন মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় এবং কোন মহিলার নিজ গৃহে নামাজের স্থানে অথবা ঘরের এক কোনে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে।
মহিলাদের ইতিকাফ
কোনো মহিলা ইতিকাফ করতে চাইলে সে বাড়ির কোনো একটি কামরায় ইতিকাফ করতে পারে। আর ওই কামরা তার জন্য মসজিদের মতো। অর্থাৎ ওই কামরা থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হতে পারবে না। যদি বের হয়, তাহলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে [আলমগিরী ১/২১১]।
ঢাকা চীফ ব্যুরো, ১০ এপ্রিল, ২০২১;