বছরজুড়েই বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কিছু পণ্যের দাম রাতারাতি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়াসহ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হওয়ায় লঙ্কাকাণ্ড বাধে সারা দেশে। এরপর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘ভয়’ থাকার কথা বাণিজ্যমন্ত্রী সংসদে জানালে শোরগোল পড়ে যায়। সমালোচনা শুরু হয় দেশজুড়ে।
এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ডিম, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ, গরুর মাংস, আলু। স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির একটি বড় অংশ আসে এই খাবারগুলোর মাধ্যমে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে বিপাকে শুধুই নিম্নআয়ের মানুষই নয় নাভিশ^াস ওঠে মধ্যবিত্তেরও। আলোচিত সেসব পণ্যের পাশাপাশি নীরবেও বেড়েছে কিছু পণ্যের দাম।
সিন্ডিকেটের কারসাজিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে আসে। ডিম ও ব্রয়লার মুরগির কারসাজিতে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান হাজার কোটি হাতিয়েছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশন। যদিও কত হাজার কোটি টাকা সিন্ডিকেটের পকেটে গেছে নির্দিষ্ট করে সেই হিসাব নেই কোনো সংস্থার কাছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এখন সব ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দরবেঁধে দামও কমানো যাবে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীরা সব সময়ই মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হলে নতুন ব্যবস্থায় যেতে হবে। এছাড়া চিরাচরিত নিয়মে সরবরাহ বাড়লে চাহিদা কমে এবং দামও কমে যায়। গরুর মাংসের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। চাহিদা কমে গিয়ে গরুর মাংসের দাম কমে গিয়েছে। নতুন বছরের মাঝামাঝি সময়ে দাম কমবে বলেও প্রত্যাশা তার।
বছরজুড়ে আলোচিত যেসব ভোগ্যপণ্য:
ডিমের ডজন মুরগির সমান
বিদায়ী বছরে দেশের সর্বকালের রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে মুরগির ডিম। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহেই হঠাৎ ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে প্রতি ডজন মুরগির ডিম বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। সেসময় প্রতি কেজি ব্রয়লাম মুরগির দামও ছিল ১৮০ টাকা। ফলে ডিম আগে না মুরগি আগে সেই বিতর্ককে ছাপিয়ে প্রথমবারের মতো এক কাতারে অবস্থান নিয়েছিল মুরগি এবং ডিম। এতে প্রোটিনের অন্যতম সস্তা উৎসটির দাম বেড়ে ভীষণ চাপে ছিল স্বল্প আয়ের মানুষরা।
রেকর্ডের বলয় ভেঙ্গেছে ব্রয়লার মুরগি
ব্রয়লার মুরগি রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়েছে গত মার্চে। পোল্ট্রি খাত অস্থির হয়ে ওঠে ব্রয়লার মুরগির প্রতি কেজির দাম ছুঁয়েছে ২৮০ টাকা। ব্রয়লারের বাড়তি দামে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। কারণ জানুয়ারিতে ১৩০ টাকায় বিক্রি হওয়া ব্রয়লার ফেব্রুয়ারিতেই ১০০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। এর পরের মাসেই তিনশ ছুঁই ছুঁই দাম ছিল ব্রয়লারের। দেশের বাজারে এর আগে কখনোই এত দামে কেজি প্রতি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ
সয়াবিন তেলের দাম গত মে মাসে পাঁচ লিটার প্রায় হাজার টাকায় পৌঁছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৯৮ টাকায় এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম বিক্রি হয়েছিল ১৮০ টাকায়। ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আঁতকে ওঠে সাধারণ জনগণ। বিশ্ব বাজারে তেলের দামের রেকর্ড বৃদ্ধির কারণে দেশেও দাম বেড়েছিল বলে মত দিয়েছিলেন বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।
ঝাল বেড়েছে কাঁচা মরিচের
কাঁচা মরিচের দামের ঝালে অস্থির হয়ে উঠেছিলো বাজার। গত জুলাইয়ের শুরুতেই কেজি প্রতি মরিচের দাম ছিল ৭০০ টাকা। হঠাৎ অতিবৃষ্টিতে মরিচগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ ফলন বিপর্যয়ের কারণে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
তেতো ছিল চিনির দাম
দফায় দফায় দাম বেড়ে তেতো হয়েছিল চিনির স্বাদ। ঈদের সময় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। পরে নভেম্বরে আবারও বেড়েছে চিনির দাম। সরকার নির্ধারিত দাম ১৩০ টাকা হলেও খুচরা বাজারে এই পণ্যের দাম ঠেকেছিল ১৫০ টাকায়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও বেড়েছিল চিনির দাম। গত সেপ্টেম্বরে ১৩ বছরের সর্বোচ্চে উঠেছিল চিনির দাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মাসিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল যে আবহাওয়ায় এল নিনোর বিরূপ প্রভাবে চিনি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চিনির দাম বেড়েছিল।
গরুর মাংসের কেজি ছুঁয়েছে আটশর ঘর
চলতি বছরের এপ্রিলে গরুর মাংসের বিপুল দাম বেড়েছিল। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৮০০ টাকা। ঈদের আগে বাড়তি চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে এই দাম বাড়ানো হয়েছিল বলে ক্রেতাদের অভিযোগ ছিল। দীর্ঘসময় চড়া ছিল গরুর মাংসের দাম। সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল গরুর মাংসের দাম। পরে ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করে।
রাতারাতি পেঁয়াজে ডাবল সেঞ্চুরি
পেঁয়াজের ঝাঁজ ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছিল একরাতেই। ভারত আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর ডিসেম্বরের এক সকালেই দ্বিগুন দাম বেড়ে গিয়েছিল। দেশি পেঁয়াজের দাম ১৪০ থেকে বেড়ে হয়েছিল ২২০ টাকা এবং আমদানি করা বা ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে হয়েছিল ২০০ টাকা। পরে পেঁয়াজের ঝাঁজ খুঁজেছেন পাতায়।
নতুন আলোচনায় নতুন আলু
আলুর দাম বছর বেড়ে শেষে তিনগুণ হয়েছে। সাধারণত শীতের ভরা মৌসুমে আলুর দাম নেমে আসে ১৬ থেকে ২২ টাকায়। কিন্তু এবার নতুন আলু আসার পরও দাম কমেনি। নুতন আলুও বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৮০ টাকায়। পুরনো আলুও একই দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বছর শেষে নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে নতুন আলুর দাম।
নীরবে বেড়েছে যেসব পণ্যের দাম
বছরজুড়ে আলোচনায় না থাকলেও কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে নীরবে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাজারের তথ্য বলে দেয় আলোচনায় না এলেও চড়া দাম ছিল রসুন, আদা এবং জিরার। এরমধ্যে রসুনের দাম গত বছর কেজি প্রতি ৮০ টাকা থাকলেও বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরের শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ২৮০ টাকায়। আদার দাম গত বছর কেজি প্রতি ১৪০ টাকা হলেও ডিসেম্বরের শেষে ২৮০ টাকা হয়েছে। জিরার দামও বেড়েছে গত বছরের তুলনায়। গতবছর জিরার দাম কেজি প্রতি ৫৭০ টাকা হলেও চলতি বছরের ডিসেম্বরে এর দাম দাঁড়িয়েছে ১১০০ টাকায়। লম্বা এবং গোল বেগুনের দাম বছরের শুরুতে ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু বছর শেষে এর দাম দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।
এক বছরে যত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বরে ৫৭টি পণ্যের মধ্যে বাৎসরিক মূল্যের বৃদ্ধি হয়েছে ৩৬টি পণ্যের। টিসিবি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে আলু। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম একবছরে বেড়ে হয়েছে ২১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। টিসিবির হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রসুন। এক বছরে রসুনের দাম বেড়েছে ২০৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
মসলার মধ্যে গত একবছরে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১২২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশি আদা ১০৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং আমদানি আদার দাম ৯১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। জিরার দামও বেড়েছে ৯১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। আমদানি করা হলুদ এবং দেশি হলুদের দামও বেড়েছে। গত একবছরে আমদানি করা হলুদ বেড়েছে ২৫ শতাংশ এবং দেশি হলুদের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ধনে বেড়েছে ৬৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এছাড়া মশলার মধ্যে লবঙ্গ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, দারুচিনি ৪ দশমিক ২১ শতাংশ, দেশি শুকনা মরিচ ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, আমদানি শুকনা মরিচ ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং দারুচিনি ৪ দশমিক ২১ শতাংশ।
সাত ধরনের ডালের মধ্যে সরকারি হিসাবে গত এক বছরে চার ধরনের ডালের দামই বেড়েছে। বড় দানার ডালের (তুরস্ক/কানাডা) দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। দেশি ডালের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অ্যাংকর ডালের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ছোলার দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। তিন ধরনের ডালের তথ্য পাওয়া যায় নি।
ভোজ্য তেলের মধ্যে দাম বেড়েছে পাম ওয়েল (লুজ) এবং পাম ওয়েল সুপারের। পাম ওয়েলের (লুজ) প্রতি লিটারে বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং পাম ওয়েল সুপারের দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
শীতের মৌসুমেও বেড়েছে সবজির দাম। সরকারি হিসেবে চারটি সবজির মধ্যে আলুর দাম গত এক বছরে বেড়েছে ২১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। কাঁচা মরিচের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। লম্বা বেগুন বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। সরকারি হিসাবে শসার দাম গত এক বছরে ২৫ শতাংশ মূল্য হ্রাস পেয়েছে দেখানো হয়েছে। যদিও বাজার ঘুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। টিসিবির ৩০ শে ডিসেম্বরের বাজার দর অনুযায়ী প্রতি কেজি শসার দাম ৩০ থেকে ৬০ টাকা দেখা হলেও বাজারে বিক্রি করছে ১০০ টাকায়।
মাছ এবং মাংসের দামও বেড়েছে গত এক বছরে। ইলিশ মাছের দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ। রুই মাছের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। খাসির মাংস বেড়েছে ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এছাড়াও সাধারণ মানের খেজুরের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ৪০ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
টাইমস ডেস্ক/ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩
              চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur