‘গাঙ্গে অবরোধের বাকি আর মাত্র হাত-আষ্ট (সাত-আট) দিন। হিয়ার হরেও ইলিশ মাছের প্যাডে ডিম নাই। অবরোধ দিলে ইলিশ মাছ নদীতে থা না, সাগর থেকে ভারতের দিকে চলি যা। ভারতের জাইল্লারা তো ইলিশ ধরা ক্ষ্যামা দে ন। তাইলে? অবরোধের লগে ইলিশ মাছ সব ভারতের দিকে যা। তাইলে আমরা কী খাইয়া বাঁচমু? সারাটা বছর ইলিশ পাই নাই। সপ্তাহ খানেক এক্কানা ইলিশ পাইছি। এখন আবার অবরোধের খবরে আমরা খুব আতঙ্কে আছি। তাদাম বছরের দেনা-পেনা কিভাবে হোধ করমু? সরকার যেন আঁঙ্গো দিকে রেনি অবরোধ তুলি নে। এ অবরোধ আঁঙ্গো ক্ষতি তো করেই, দেশেরও ক্ষতি করে।’ ক্ষোভের স্বরে কথাগুলো বেরিয়ে এলো নোয়াখালীর দ্বীপ অঞ্চল হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটের নৌকার মাঝি মো. নূর আলমের মুখ থেকে।
উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রমত্তা মেঘনা আছড়ে পড়ছে সাগরের বুকে। সাগর আর নদী মিলেমিশে একাকার এ মোহনায়। এখানেই ইলিশ শিকার করে জীবন ধারণ করেন তিনি। কিন্তু পুরো বছরের হতাশা, ঋণের বোঝা, অবিরত কষ্ট সহ্য করে যখন কিছু ইলিশ পাচ্ছেন; তখন ইলিশ অভিযানের খবর তার বুকে বুলেট ছোঁড়ার মতো। এ বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর মোট ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তিনি আঁতকে ওঠেন এ খবরে। শুধু তিনি নন। এমন অবস্থা হয়তো সব জেলেরই।
নদীর উত্তাল মোহনা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগ-দুর্বিপাক এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিধ্বংসী পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে বাঁচতে হয় তাদের। তাছাড়া জলদস্যুদের ভয় তো থাকছেই। প্রকৃতির বিপন্নতার সংকট আর জলদস্যুদের ভয়কে জয় করে এ জেলেদের জীবনের গতিপ্রকৃতি বয়ে চলে। জলদস্যুদের অত্যাচারের ভয়ে বিকাশের মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধের বিষয়টিও এখন বেশ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝ নদীতে এসব জেলেদের আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। যদি তাৎক্ষণিক আটকা পড়া জেলেদের কাছ থেকে অর্থ না মেলে তাহলে জেলেদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে জলদস্যুদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ মিলছে অহরহ।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনার জেলে দুলাল মাঝি। জীবনের ৫০ বছর ধরেই নদীতে মাছ ধরছেন। কেমন আছেন তিনি জানতে চাইলে বলেন, ‘কিভাবে ভালো থাকি? একবছরে ইলিশ হাই মাত্র দেড় মাস। এটা কি হয়? তাদাম বছরটা গেল ইলিশ নাই নাই করে। সংসারের খরচ তো দূরের কতা, আঁর নাঁওয়ে আষ্টজন জাইল্লা। তাদের খরচ চালান তো সম্ভব হচ্ছে না। আঁর জীবনে অন সবচাইতে খারাপ সময় হার করতেছি। কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক। এটাই বাস্তব। একেকটা নৌকা বানাতে দুই থেকে তিন লাখ টিয়া খরচ করতে হয়। সে হিসেবে আমরা মাছ পাই না। মাছ একটু পাইলেই অভিযান শুরু হয়।’
আড়তদার ও সাবেক ইউপি সদস্য মো. নাজির আহম্মেদ বলেন, ‘অভিযানটা দেওয়া হয় বিদেশি চক্রান্তে। বিশেষ করে ইকোফিশ। এরা উপর থেকে টাকা খায় আর সরকারকে ভুল তথ্য দেয়। ঠিকমতো এদেরকে নদীরপাড়ে দেখা যায় না। এতে সরকার অভিযান দিলে ইলিশ চলে যায় ইন্ডিয়ার দিকে। এ অভিযান দেশের জন্য ক্ষতিকর, জেলেদের জন্যও ক্ষতিকর। এ অভিযানের কারণে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন বিলীন হচ্ছে। এতে ভারত সরকার ইলিশ পাচ্ছে প্রচুর।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকার অভিযান দিলে বাংলাদেশের জেলেরা নদীতে নামে না। অন্যদিকে ভারতের জেলেরা ঠিকই নদীতে ইলিশ ধরে। এতে তাদের জেলেরা কোটি কোটি টাকা আয় করছে। আমাদের দেশের জেলেরা নিস্ব হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তারা ইলিশের বিরাট ক্ষতি করছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই- এ অভিযান নামক অভিশাপ তুলে নেওয়া হোক। যদি এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে তাহলে আমরা অনশন ধর্মঘটে যাবো।’
আবদুল ওয়ারেছ শরীফ। সারা বছর নদীতে ইলিশের দেখা না মেলায় নদীতে যাননি। এখন ইলিশ শিকারের জন্য যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘অভিযানের সময়টা আরো পেছানো দরকার। অভিযানের পরেও ইলিশে ডিম পাওয়া যাবে। এখন তেমন ডিম নেই। মিডিয়াম রকমের ইলিশ ধরা পড়ছে। এজন্য অভিযানের তারিখ পিছিয়ে দিলে ভালো হতো। আমরাও এতে উপকৃত হতাম, দেশের জন্যও ভালো হতো।’
ইউপি সদস্য (প্যানেল চেয়ারম্যান) ও মেঘনা তীরের মতিরহাট ইলিশ ঘাটের সভাপতি মেহেদী হাসান লিটন অভিযোগের সুরে বলেন, ‘নদীতে তেমন ইলিশ পাচ্ছি না আমরা। এবছর ব্যবসায় পুরোই ধস নেমেছে। আর কত লোকসান দিতে হবে? আমরা কি পুরো বছরের ক্ষতি পোষাইতে পারবো? তা মনে হয় না। অভিযানের তারিখটা পরিবর্তন করলে জেলেরা স্বাবলম্বী হতো। জেলেরা অভিযান মানে। কিন্তু সঠিক সময়ে অভিযান দেওয়া খুবই জরুরি। বাংলাদেশের ইলিশ যেন অন্য রাষ্ট্র শিকার করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিতে হবে।’
নোয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আবদুল মোতালেব বলেন, ‘আগের মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ইলিশ খুব কম পাওয়া যায়। তবে সবার সহযোগিতায় আমরা অভিযান সফল করি। সে হিসেবে প্রতিবছর পূর্ণিমার আগের চার দিন ও পরে সতেরো দিন অভিযানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।’
বরিশালের মৎস্য অফিসের ইলিশ গবেষক বিমল চন্দ্র দাস মনে করেন, ‘এখন ভরা মৌসুম। মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে নদীর মোহনা থেকে মোহনায় মা ইলিশ ছোটাছুটি করে। জেলেদের অভিযোগের বিষয়েও একটি বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। যদি এখন ইলিশ ধরা বন্ধ না হয়, পরে তো ইলিশ উৎপাদন কমে যাবে। দেশের ইলিশ সম্পদ বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’
(জাগো নিউজ)