বই সভ্যতা বিকাশের সিঁড়ি ও সবচেয়ে ভালো বন্ধু

আজ ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস। বিশ্ব বই দিবস বা বিশ্ব গ্রন্থ দিবস হচ্ছে পড়া,প্রকাশনা এবং কপিরাইট বহুল প্রচারের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা,বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন (ইউনেসকো) দ্বারা আয়োজিত একটি বার্ষিক দিবস।

ইউনেসকো ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম বারের মতো বিশ্ব বই দিবস উদযাপন করে। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। অবশ্য এ সম্পর্কিত একটি দিবস যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডে মার্চ মাসে পালন করা হয়।

অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরন্তন আগ্রহ, তা বই পড়ে মেটানো হয়। একটি ভালো বই-ই হচ্ছে মনের খোরাক জোগানোর অন্যতম উপায়। একটি ভালো বই ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তোলে। জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করতে হলে,সুবাসিত করতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হয়।

আর জ্ঞানার্জন করতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানের কথা যেন বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে। নিজেকে জানতে হলে,পৃথিবীকে জানতে হলে বই পড়তেই হবে।

একজন মানুষ যে পেশায় যত দক্ষই হোক না কেন,যত বড় পণ্ডিত বা জ্ঞানীই হোক না কেন, তার দক্ষতা ও পেশাদারিত্বে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য তাকে বারবার বইয়ের কাছেই ফিরে আসতে হয়।

এজন্য বলা,জ্ঞানার্জনের প্রধান মাধ্যম এবং জীবনকে আপন আলোয় আলোকিত করার প্রধান উপায়ই হচ্ছে বই। বই পড়েই জ্ঞানার্জন করতে হয়। পৃথিবীতে যারা যত বড় হয়েছেন,জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন,তারাই বেশি বেশি জ্ঞান অন্বেষণে বই পড়েছেন।মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যতীত দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যতীত দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়্ ।

পৃথিবীর যে কোনো বরেণ্য মনীষীদের জীবন-ইতিহাস ঘাঁটলে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। বই হচ্ছে শেখার, জানার ও জ্ঞানার্জনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। দেশ ও জাতি গঠনে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। আর সহজ উপায়ে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়াতে সমাজের জন্য বই অপরিহার্য। বইয়ের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না।

একজন প্রখ্যাত লেখক বলেছেন,‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়নি,বই কেনার বাজেট যদি আপনি তিন গুণও বাড়িয়ে দেন, তবুও তো আপনার দেউলে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ আসলেও তাই, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়েছে এমন কোনো খবর কখনো পাওয়া যায়নি, কিন্তু বই পড়ে জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, দেশ ও জাতি এবং মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে পেরেছে,এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত।

বই পড়ার গুরুত্বও অপরিসীম। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন,‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’।

সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে মানুষকে বই পড়তে হবে। কারণ বই পড়ার মাধ্যমেই প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হয়। বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি তার চিন্তাশক্তি,যুক্তি,বুদ্ধির জাগরণ ঘটে,যা একজন স্বশিক্ষিত মানুষের জন্য অপরিহার্য।

বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানের রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ হলো সাহিত্যচর্চা। আর সাহিত্যচর্চা করতে হয় বই পড়ে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায় বলতে হয় যে,আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি হচ্ছে বই।

মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষের পাঠ অভ্যাসের তথ্য পাওয়া যায়। মানুষ বই পড়ে মনের খোরাকের জন্য,অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার জন্য। জ্ঞানের সূচনা বই থেকেই এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়ে পেয়ে থাকে।

আমাদের পড়া উচিত সেসব বই, যেসব বই ব্যক্তির মনের খোরাক জোগায়, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। এসব বইয়ে আছে জীবনকে সুন্দর করার ভাষা। বই মানুষের নিঃস্বার্থ বন্ধু। ‘আত্মার ওষুধ’ এ কথাটি গ্রিসের থিবসের লাইব্রেরির দরজায় খোদাই করা আছে। তারা বিশ্বাস করে যে, বই হলো আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন,‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে,কিন্তু বইখানি অনন্ত যৌবনা’। আপনি যত পড়েন তত জানেন এবং জানার সঙ্গে বদলে যায় আপনার দেখার চোখ।

বদলে যায় বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। একটি প্রবাদ আছে, একজন অশিক্ষিত মানুষ কাদাকে দেখে শুধু ভেজা মাটি হিসেবে। আর এক জোড়া শিক্ষিত চোখ সেই কাদার মাঝে খুঁজে পায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণু।

সপ্তদশ দশকের দার্শনিক বারুখ স্পিনোজা বলেন,‘ভালো খাদ্যবসস্তু পেট ভরে কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।’ বড় হতে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে,আর স্বপ্ন দেখার জন্য বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।’

কোভিড-১৯-পরবর্তী ভুলে যাওয়ার সমস্যা কোভিড-১৯-পরবর্তী ভুলে যাওয়ার সমস্যা
বইয়ের প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। বিশেষত আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে শৈশব থেকেই এ বোধ জাগিয়ে দিতে হবে।

কারণ, বিদ্যালয়ে যে পুঁথিগত জ্ঞান শিশু-কিশোররা লাভ করে তাতে মেধার তেমন বিকাশ ঘটে না। তাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাকে বই পড়তে উত্সাহিত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পাঠে গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করে আমরা প্রতিষ্ঠিত হব। আর প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়লে জ্ঞানের দ্যুতি বাড়বে এবং আমরা আলোকিত হব। কারণ,সফলতার ক্ষেত্রে বই পড়া একটি প্রধান চাবিকাঠি।

বিল গেটস কিংবা এলোন মাস্ক-এর মতো বিশ্বসেরা ধনী এবং সফল মানুষেরা তাদের সময়ের একটি বিশাল অংশ বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন।

গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, পড়ার অভ্যাস মানসিক চাপ কমায়, মনোযোগ বৃদ্ধি করে এবং দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটায়। আলোকিত নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে বই পড়ার বিকল্প নেই। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

এজন্য বই পড়া একই সঙ্গে সুস্থ বিনোদন ও শিক্ষামূলক কাজগুলোর মধ্যে একটি। সুস্থ বিনোদন মানুষের মানসিক বিকাশে নানাভাবে সহায়তা করে। পাঠাভ্যাস একটি নির্মল বিনোদনের উত্স।

ভালো বই পড়া,ভালো সিনেমা দেখা, বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের জীবনীগ্রন্থ পড়া, নিয়মিত খবরের কাগজ পড়া যেমন দক্ষতা ও মনের খোরাক বাড়ায়,তেমনি জ্ঞানচর্চা এবং সৃজনশীল কাজ মানসিক বিকাশে অন্যতম ভূমিকা রাখে।

সবচেয়ে কাছের বন্ধুও মানুষকে ছেড়ে যেতে পারে কিন্তু বই সেটা করে না। এজন্য বই হোক মানুষের নিত্যসাথি,সুস্থ বিনোদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ও সভ্যতা বিকাশের চাবিকাঠি।

লেখক: মো.জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার,২৩ এপ্রিল ২০২২ ।
এজি

Share