প্রিয় কবি নজরুলের সাহিত্যচর্চার বিকাশ

কবি নজরুলের শিশু, কৈশোর ও সৈনিক জীবনের নানা বৈচিত্র্য পূর্ণতায় কাটিয়েছেন। সৈনিক জীবন শেষে ১৯১৯-১৯২০ সাল থেকে তাঁর শুরু হয় এক অনিশ্চত জীবনের অধ্যায়। ঐতিহাসিক বিদোহী কবিতা রচনা,নার্গিস ও প্রমীলার সাথে বিয়ে,কুমিল্লায় রবিবার আাসা,বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ,কবিতা,নাটক, প্রবন্ধ,গান,গজল,ইসলামী গান ইত্যাদি রচনার ক্ষেত্রে তিনি বাংলা সাহিত্যে তার বিকাশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।

পাশাপাশি সাংবাদিকতা,রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে অভিনয়, সুরকার,সংগীত পরিচালক,নাট্যকার, বিশ্বকবি বীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য এসবই উন্মেষ ঘটে। ১৯২০ সাল থেকে নার্গিস ও প্রমীলার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ। বুলবুলের মৃত্যু, মা জাহেদা খাতুনের মৃত্যু,ধূমকেতু রচনায়র দায়ে কারাবরণ,প্রভৃতি অধ্যায়গুলো কবিকে নানাভাবে উচ্চসিত উদ্বেলিত করে।

কবির জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রেম-ভালোবাসা,বিপ্লবী মনোভাব, বিদ্রোহের আগুন,কবিতা,গল্প, প্রবন্ধে, গানে ,গজলে ও ইসলামী সঙ্গীতে তাঁর সৃজনশীলতার এ কবি নানা প্রতিভার উন্মেষ ও অধ্যায় সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এতোগুলো শাখায় তাঁর যে অপরিসীম অবদান-তা পরিমাণ করাও অকল্পনীয়। সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভার ব্যক্তি। পত্রিকায় সম্পাদনা ও সাংবাদিকতায় তিনি তাঁর গ্রন্থাবলী প্রলয় শিখা, রক্ততিলাল পথসুগম হয়।

যতদূর জানা সম্ভব হয়েছেÑএগুলোর মধ্যে কাব্যগ্রন্থের অগ্নিবীণা,সাত ভাই চম্পা,নির্ঝর (১৯৩৮),ঝড়,শেষ সওগত, রাঙা জবা, প্রলয় শিখা (১৯৩০), সবিততা,সর্বহারা, মৃত্যুক্ষুধা, আগমনী (১৯২৮), কুহেলিকা, কিশেরবাণী (১৯২৪), ভাঙ্গার গান, সাম্যবাদী, ফনিমনসা, জিঞ্জির, সন্ধ্যা (১৯২৯), দোলনচাঁপা (১৯২৩), চক্রবাক, (১৯২৯), সিন্ধু হিল্লোল (১৯২৬) ইত্যাদি। ঝিঙেফুল (১৯২৬), ছায়ানট (১৯২৫),বিত্তনামা (১৯২৫), পর্বের হাওয়া (১৯২৫), সাম্যবাদী (১৯২৫) গল্প : ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলী মালা,পদ্মগোখরা, জিনের বাদশা।

১৯২৯ সালের পর থেকে ১২ বছর যাবত নজরুল সংগীত রচনায় মনোনিবেশ করেন। ২৫টি নাটকের মধ্যে জিরামাল। ২৫টি নাটকের মধ্যে : ঝিলামালা, আলেয়া,পুতুলের বিয়ে, মধুমালা।উপন্যাস : বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা। প্রবন্ধ : যুগবাণী, দুর্দিণের যাত্রী, রাজবন্দির জীবনবন্দি, ধূমকেতু ও রুদ্র মহবল। জীবনীকাব্য: মরু ভাস্
অনুবাদ : রুবাইয়াত হাফিজ ও রুবাইয়াত, ওমর খৈয়াম।গানের সংকলন : বুলবুল, মুরবাকী, গুলবাচিকা, রণসঙ্গীত, জুলফিকার,চন্দ্রবিন্দু,মুরারপি, চিত্রনামা, চোখের চাতক, নজরুলনীতি, গানের মালা,স্বরলিপি, গীতিশতদল, সুরমুকুর ইত্যাদি। যেগুলো ছিল প্রথম রচনা এগুলোর মধ্যে রয়েছে-‘সন্ধ্যা প্রথমকাব্য,গল্পগ্রন্থ ১৯২২,ব্যথার দান, রচনা-বাউন্ডেলর আত্মকাহিনী, কবিতা মুক্তি,কাব্যগ্রন্থ- অগ্নীবীণা। উপন্যাস : বাঁধনহারা, প্রবন্ধ, তুর্কি মহিলার ঘোমটা, প্রবন্ধ-যুগবাণী।

কবি নজরুলের রচনাবলীগুলো অধিকাংশই বাংলা, আরবী-ফার্সি, উর্দু শব্দের সংমিশ্রনে হওয়ার কারণেই অনেক শিক্ষার্থী উচ্চারণেও অর্থ বুঝতে অনেকটাই সমস্যায় পড়েন। পল্টনে সেনিক জীবনেই তার লেখার উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং ফার্সি ভাষা শিখার সুযোগ হয়।

কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-বিদ্রোহী কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত পান সাহিত্য চর্চার দিনগুলোতে। তাঁর এ বিশেষ বিশেষণটি তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত হয় বিদ্রোহী কবিতার রচনার মধ্য দিয়ে। এ কবিতাটি লিখে তৎকালীন কলকাতা যথা বাংলা-ভারত বর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করেন প্রিয় কবি নজরুল। বৃটিশদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার ও নিপীড়ন ও জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আহŸান জানিয়েছেন প্রিয় কবি নজরুল।

কবি নজরুল ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পাকিস্থানের করাচি থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ফলে সর্বপ্রথম কলিকাতায় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে পরিচয় হয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। এ বছরই নজরুল তার সম্পাদনায় ‘সান্ধ্য দৈনিক ‘নববুগ’ প্রকাশিত হয়।

১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় নজরুল আবহাওয়া জনিত কারণে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ফলে কাব্যগন্থটি স্ব স্ব আজজালুল হকের নিকট ছেড়ে দেন বা বিক্রি করেন। তিনি দেহঘরে থাকাকালীন সময়ে নজরুলের ঐ সময়ের রচনাটি-মোসলেম ভারতে প্রকাশের জন্য পাঠাগার কথা বলেন। আফজালুল হক নজরুলকে একখানা পত্রিকারের প্রকাশের কথা বলেন।

বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে পরাধীনতার ছিড়ে জাতীয় তরুণ সমাজকে সু-শৃঙ্খল হতে সহায়তা করেছিলেন বিদ্রোহী কবিতা। জীর্ণশীর্ণ ও দু’বছরের যুগে একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোসণমুক্ত সমাজ গঠনে কবি বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে আহŸান জানান।

বিদ্রোহী কবিতার ১৪টি ছোট বড় স্তবক, ১৪১টি লাইন বা পংক্তি এবং ১৪৫ বার আমি শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘আমি ’ দ্বারা তিনি হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন-ভারত বর্ষের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি। তিনি কবিতার ভাষায় বলতে চেয়েছেন কারো অধীন হয়ে নয়- বরং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের সার্থকতা।

ভাব-ভাষা ও উপমা-ছন্দে বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত এক অনবদ্য রচনা। বিদ্রোহী কবিতাটি যখন তিনি রচনা করেন-তখন ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোদী গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং এক উত্তাল হাওয়া বিদ্যমান ছিল। গোটা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। এর মধ্যেই তার কালজয়ী রচনা বিদ্রোহী।

যতদূর জানা গেছে, ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে ৩-৪ সি তালতলা লেনের বাড়ির নিচ তলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ঘরে বসে নিবিড় পরিবেশে তিনি বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেন। ১৯২২ সালের জানুযারি কবিতাটি অবিন্যাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিজলী’পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

পরের দিন তিনি নিজেই বিজলী পত্রিকাটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুটিরে গিয়ে আবৃত্তি করে শুনান। কবিগুরু অভিভূত হন। সেই থেকে তাঁর নাম চারদিকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে বিদ্রোহীকবি বলে স্বীকৃতি লাভ করেন।

এরপর কবি নজরুল তুর্কি মহিলার ঘোমটা খোমা,সওগাত পত্রিকায় তাঁর রচিত প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। ১৯২২ সালের দৈনিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেন। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। ধূমকেতা পত্রিকাটি সেপ্টেম্বর মাসে বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁর বিখ্যাত অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থটিও এ সময় প্রকাশ হয়।

‘ধূমকেতু’র মামলা ১৯২৬ সালে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে তিনি একটি জবানবন্দি দেন। পরবর্তীতে এটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে। বিচারের রায়ে কবি’রএক বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। কবি ডিসেম্বরে মুক্তিপান। পরে এটি নজরুলের রচিত সর্বাধিক কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণায় সংকলিত হয়েছে ।

তথ্যসূত্র : মো.হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল, নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা ,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত -‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘ কাজী নজরুলের জীবনী’ এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি) (৭ম পর্ব শেষ – চলবে আরও ক’টি পর্ব )

লেখক : আবদুল গনি , শিক্ষক, সাংবদিক ও সাধারণ সম্পাদক , নজরুল গবেষণা পরিষদ , চাঁদপুর। ০১৭১৮ ২১১-০৪৪,
৮ মে ২০২১

Share