Home / জাতীয় / সারাদেশের স্কুলগুলোতে অভিভাবকদের পকেটকাটা চলছে
সারাদেশের স্কুলগুলোতে অভিভাবকদের পকেটকাটা চলছে

সারাদেশের স্কুলগুলোতে অভিভাবকদের পকেটকাটা চলছে

‘কিছু বলতে গেলেই বাচ্চা বের করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়’বছরের শুরুতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় স্কুলগুলোয় অস্বাভাবিক বেতন বাড়ানো নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক দিন ধরে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে অভিভাবকেরা প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করে আসছেন। অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধির এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ঢাকার আরও ছয়টি স্কুল।

এসব স্কুলের মধ্যে রয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল, উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত বেতন বাড়ানো হয়েছে। এই বিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার।

এর বাইরে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, বিয়াম স্কুল, সেন্ট যোসেফ স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বেতন বাড়লেও তা সহনশীল বলে মত দিয়েছেন অভিভাবকদের কেউ কেউ।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন ও ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল সংহতি সভা হয়েছে। নৌবাহিনী স্কুলে বেতন-ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদেও শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা সড়ক অবরোধ করেছেন। চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন পরিচালিত ৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার।

স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী তারা সরকার থেকে শতভাগ মূল বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আংশিক পায়। বাকিটা শিক্ষার্থীদের বেতন ও প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে সংস্থান করতে হয়। সরকার থেকে শতভাগ মূল বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও শতভাগ পেলে হয়তো বেতন বাড়ানোর দরকার হবে না বলে জানায় তারা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নের বিষয়টি খোঁড়া যুক্তি হিসেবে মন্তব্য করে বলেন, এখন যেভাবে বেতন বাড়ানো হচ্ছে, তার লাগাম টেনে ধরতে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ, উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ফি নেওয়া যাবে। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা গত বছরও মানেনি। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যায়নি।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল: গতকালই উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের বেতন অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে শ্রেণিভেদে কমপক্ষে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেতন বেড়েছে। একজন অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে এবার চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। গেল বছর ১ হাজার ৫০০ টাকা বেতন ছিল, এ বছর তাঁকে দিতে হবে ২ হাজার ৫৫০ টাকা। প্রথম শ্রেণিতে বেতন ছিল ১ হাজার ৩০০ টাকা, বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ হাজার ১৫০ টাকা।

জানতে চাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন বলেন, স্কুলে ৪৩২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য পে-স্কেল বাস্তবায়ন করতে যে অর্থ দরকার, তার চেয়ে ১০ শতাংশ অর্থের ঘাটতি আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের বেতন গড়ে ৪৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের প্রতিনিধি শামিমা সুলতানা বলেন, ‘সকাল সাতটা থেকেই আমরা স্কুলের ফটকে ছিলাম। হঠাৎ চারজন লোক এসে আমাদের মধ্যে কে কে রোববারের সংবাদ সম্মেলনে ছিলাম, তা জানতে চান। এরপর আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুলে অভিভাবকদের প্রতিবাদ: ভিকারুননিসা নূন স্কুলে বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে অভিভাবকেরা বেইলি রোডে জড়ো হলে গতকাল পুলিশ ডেকে আনা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বলেন, প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে ৮০০ টাকার বদলে ১ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করার খবর শুনে অভিভাবকেরা সোনালী ব্যাংকে খবর নিতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, প্রতিটি ক্লাসেই বেতন বাড়ানোর নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে স্কুল থেকে। সোমবার অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন অভিভাবকদের জানিয়েছেন, বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। গতকাল বেলা একটার সময় অভিভাবকেরা বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে গিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও পারেননি।

স্কুল ফটকের সামনে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া দুই ছাত্রীর মা বলেন, ‘দুই মেয়ের বেতনই বেড়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৯০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা।’

উদয়নে বেতন বেড়েছে শতভাগ পর্যন্ত: উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেতন বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। একজন অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদয়ন বিদ্যালয়ে দুই ধাপে বেতন নেওয়া হয়। প্রথম-ক ও প্রথম-খ শ্রেণিতে বেতন ছিল ১ হাজার টাকা, সেটি করা হয়েছে ২ হাজার টাকা। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বেতন ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। অথচ গেল বছর স্কুলের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, এ বছর বেতন ১০ শতাংশ বাড়বে।

বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ উম্মে সালেমা বেগমের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

প্রিপারেটরিতে ভর্তি ফি এক লাফে দ্বিগুণ: মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ভর্তি ফি দ্বিগুণ করেছে। গত বছর ৫ হাজার টাকায় সন্তানকে ভর্তি করাতে পারলেও এ বছর অভিভাবককে গুনতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ নিয়ে অভিভাবকেরা অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে বেলায়েত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।

শহীদ পুলিশ স্মৃতিতে বেতন ও ভর্তি ফি বেড়েছে: মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুলে বেতন বেড়েছে ৩০০ টাকা। কিন্তু ভর্তির সময় কর্তৃপক্ষ ‘পুষিয়ে নিয়েছে’। একজন অভিভাবক বলেন, ‘গত বছর আমার বাচ্চা ভর্তিতে খরচ হয়েছিল ৮ হাজার টাকা। এ বছর খরচ হলো ১২ হাজার ৭৬৫ টাকা। কিছু বলতে গেলেই বাচ্চা বের করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়: এই স্কুলের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত টিউশন ফি ২৫০ টাকার জায়গায় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫০ টাকা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ফি ৩৫০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এখানে ভর্তি ফিও বাড়ানো হয়েছে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন ভর্তি ফি ২ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর পুনর্ভর্তি ফি আদায় করা হচ্ছে ৪ হাজার টাকা।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর বলেন, বেতন নির্ধারণ ও বৃদ্ধির বিষয়ে নীতিমালা করার দাবি জানিয়ে ফোরামের পক্ষ থেকে গত ১১ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ও সচিব বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরা।

ছাত্র ইউনিয়ন গতকাল মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে ১৯ জানুয়ারি বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

বেতন বেড়েছে চট্টগ্রামেও: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল সংহতি সভা হয়েছে। ‘চসিক অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবৃন্দ’-এর ব্যানারে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই সংহতি সমাবেশ হয়। সমাবেশ পরিচালনা করেন অভিভাবক শিখা দেবী। ভর্তি ফি ও বেতন দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে মেয়রের প্রতি আহ্বান জানান তাঁরা।

এদিকে নৌবাহিনী স্কুলে অধ্যয়নরত দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, বিদ্যালয়ে ভর্তি ফি সাড়ে ৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার ১৪০ টাকা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিদ্যালয়ের সামনে বিমানবন্দর সড়কের এক পাশে অবস্থান নেন। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ দুর্ব্যবহার ও লাঠিপেটা করে তাঁদের সড়ক থেকে তুলে দেয়।

তবে নগরের ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে তাঁরা সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন।

একাধিক স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক বলছেন, যে ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তে বেতন বাড়ানো হচ্ছে, তার সভাপতি পদে আছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধিরাই।

বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘জাতীয় বেতন স্কেলের অজুহাতে কিছু প্রতিষ্ঠান যা করছে, সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিচালনা পর্ষদ যা খুশি তা করতে পারেন না। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, মন্ত্রণালয়েরও নীতিমালা রয়েছে।’

সূত্র : প্রথম আলো

নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০১:২৫ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬, বুধবার

এমআরআর