সাম্প্রতিক শিক্ষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোনো কোনো ব্যক্তি ও সংগঠন শিক্ষকদের মান-মর্যাদা,যোগ্যতাও দক্ষতা নিয়ে ক্রমাগত কুৎসা রটনার মাধ্যমে আক্রমণ করে ব্যাক্তি মেটো বা ফেইজবুকে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বেসরকারি শিক্ষকদের মনে অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
বেসরকারি শিক্ষকদের যেনো কোনো চাওয়া-পাওয়ানেই,দাবি-দাওয়া থাকতে নেই কিংবা জীবন-মান উন্নয়নের স্বপ্ন নেই। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে,খামোস হয়ে, নীরবে নিভৃতে কর্তার হুকুম পালন করতে হবে। শব্দ চয়নেও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাব, অপমান অপদস্ত করার জন্য ডিকশনারিতে যত শব্দমালা আছে তার প্রায় সবগুলোই অকৃপণভাবে তিনি ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
এক কথায় কুমড়ো কোপান কোপাচ্ছেন। প্রশ্ন করছেন- ‘ ওরা ’ কি চায় ? ‘ওদের’ বিসিএস আছে ? ওদের কি পিএসসি আছে? ওরা রাতারাতি ক্যাডার হতে চায় ? এমন নানা রকম তির্যক প্রশ্নও মন্তব্য শুনতে শুনতে নিজেকে বড়ো অসহায় ও খুবই নগন্য মনে হচ্ছে।
নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছি। কেনো ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে, বিএডিসির সরকারি চাকরি পরিত্যাগ করে,এ পেশায় নাম লিখালাম ? আমার দোষ কোথায় ? আমিতো তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি মালার আলোকেই প্রতিযোগিতামূলক প্রতিদ্বন্ধিতার ভেতর দিয়ে নির্বাচিত হলাম। তবুও আমি এতো নিকৃষ্ট কেন ? এতো উচ্ছ্বিষ্ট কেন? জীবনের শেষ সময়, ফেরার তো পথ নেই। এ ভুলের খেসারতের দায় কি আমার ?
আমি নিম্নমানের অযোগ্য সহকারী শিক্ষক ছিলাম । আমার হাত দিয়ে আমি যে সকল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ক্যাডার তৈরি করেছি-তাদের মান নিয়ে আজ আমি শঙ্কিত। তবুও দোয়াকরি যারা আমার স্পর্শ পেয়েছে,তারা যেনো আমার মতো নিম্নমানের না হয়। কিছু ব্যক্তি বা সংগঠন স্বীকার করুক বা না করুক- রাষ্ট্র,সমাজ ও সাধারণ মানুষ মনে করে- পরিবেশ পরিস্থিতি, প্রতিশ্রুতি ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের দিক থেকে এখনও শিক্ষক সমাজ কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে।
তাঁদের প্রতিনিয়ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। অভাব অভিযোগ ও বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় । ভবিষ্যৎ নিযে ভাবতে হয় । নিগৃহীত হতে হয়, কুৎসার স্বীকার হতে হয়, নানা রকম অত্যচার ও হয়রানির মধ্যে দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। তাঁদের খোঁজ কি কোনো কর্তাব্যক্তি নিয়েছেন? শাসন, সমালোচনা,খবরদারি,পাথর চাপা,বুড়িগঙ্গার জল খাওয়ান,আঁটি বেধে পেটান,মামাবাড়ির আবদার বলেন আপত্তি নেই। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের হাঁড়ির খবর নেন। তাঁদের পাশে বসুন।
তাঁদের বুকের দীর্ঘশ্বাস শুনুন। তাঁদের চোখ-মুখের দিকে তাকান। তাহলে বুঝতে পারবেন আপনার ‘ ওরা ’ ভালো নেই। শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে এসে ভার করলে তাকে কি সুস্বাস্থ্য বলা যায় ? যায় না। বরং প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে,শিরা-উপশিরায় রক্তের সুসম প্রবাহ বিদ্যমান থাকলেই তাকে সুস্বাস্থ্য বলা যায়। তেমনি ক্যাডার শিক্ষকরা ভালো থাকলেই ৯৭% শিক্ষকের ভালো থাকা বুঝায় না।
শিক্ষকরা সচেতন নাগরিক। তাঁরা পেশাগত দায়িত্ব বুঝে।রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজনীতি ও ধর্মকর্ম সম্পর্কে তাঁদের বেসিক ধারণা কম- এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই।
শিক্ষকদের আন্দোলনের ঐ দাবিটা আজকের নয়। যুগের পর যুগ শিক্ষকরা এ দাবিতে সোচ্চার ছিল, আছে এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সোচ্চার থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন যেনো নিজ স্বার্থে এ বিপুল শিক্ষক গোষ্টিকে রাজনৈতিক বলির পাঠা বানিয়ে, কোণঠাসা করে ও খাদের কিনারে ঠেলে দিতে না পারে। সে ব্যাপারে সচেতন মহলের দৃষ্টি রাখা দরকার।
আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মুখে ছিল জয় বাংলা, স্লোগান ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, কন্ঠে ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জয়ধ্বনি। কোন বিচারে, কোন মানদন্ডে এ বিশাল শিক্ষক সমাজকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। আন্দোলনকারী সকল স্বাধীনতার বিপক্ষে আর যারা ঘরে বসে আছে তারা স্বাধীনতার সোল এজেন্ট, এমন সরল ভাবনার মাঝে প্রচন্ড গলদ আছে।
জামাতপন্থী আদর্শ শিক্ষক সংগঠন,সেলিম ভুঁইয়ার ঐক্যজোট আন্দোলনে আসে নি এমনকি সংহতি ও জানায়নি। এদের ব্যাপারে কি মন্তব্য করবেন? এরা কোন রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করে ? তার জবাব কি দেবেন ?
সাধারণ শিক্ষকদের ধারনা জাতীয়করণ হলে কিছু ব্যাক্তি ও সংগঠন যারা বিভিন্ন সংস্থায় বসে আছেন, তাদের মাতাব্বরি করার ক্ষমতা হারাবেন এটা নিশ্চিত। তাই যাতে জাতীয়করণ না হয় এর জন্য যত রকমের বুদ্ধি -পরামর্শ ও কুটচাল বিভিন্ন দপ্তরে অধিদপ্তরে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছেন।
যত রকমের বাঁধা আছে ওনারা দেবেন, যত রকমের শৃঙ্খল আছে ওনারা পড়াবেন, ওনারা খাঁচায় পুরতে চাইবেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষক শেকল ভাঙার গান গেয়ে (” এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে”) মুক্তির ইচ্ছে নিয়ে বারবার ফিরে আসবে। এশিয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ সেরা। এ অর্জন কি এমনি এমনি এলো ? এখানে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের অবদান অস্বীকার করবেন কোন মুখে?
পরিশেষে বলতে চাই -এ বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস রাষ্ট্র্রীয়ভাবে উদযাপন করার সরকারি উদ্যোগ নি:সন্দেহে আশা জাগানিয়া পদক্ষেপ্ । ব্যক্তিরা যতই চেষ্টা করুন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখুন। আমার বিশ্বাস শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসাান হবে এ সরকারের হাত ধরেই।
লেখক :মো.আব্বাস উদ্দিন, প্রধানশিক্ষক,গণি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ও সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, চাঁদপুর জেলা শাখা, চাঁদপুর-৩৬০০। আগস্ট ৬,২০২৩ ।
এজি