সাংবাদিকতায় কিছু ভুল কিছু চালাকি

সাংবাদিকতার কিছু ভুল নিয়ে অনেক আলোচনা, বিতর্ক হয়েছে। আবার কিছু বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে সাংবাদিকরা খুব একটা কথা বলেন না বা হয়ত বলতে চান না। কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনার দরকার আছে।

শুধু ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়নের শিকারের নাম প্রকাশেই বাধা?

সাংবাদিকতার প্রাথমিক স্তরেই সবার জানা হয়ে যায় যে, সংবাদে কোনো অবস্থাতেই ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়নের শিকারের নাম প্রকাশ করা যাবে না। এটা মোটামুটি সবাই জানেন বলে ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়নের শিকারের নাম প্রকাশিত হতে খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে ধর্ষিতার এলাকার নাম বা তার কোনো আত্মীয়ের নাম বা পরিচয় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। যারা প্রকাশ করেন, তাদের আসলে নাম, পরিচয় প্রকাশ না করার পেছনের কারণগুলো সম্পর্কেই হয়ত ধারণা নেই। নইলে তারা নিশ্চয়ই বুঝতেন, এলাকা, বিশেষ করে আত্মীয়ের নাম প্রকাশ করলে যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকারের নাম জানাজানি হতে বিশেষ কিছু বাকি থাকে না।

এ বিষয়টি ‘কমন সেন্স’ থাকলেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, অনেকেরই যেন সেই সেন্স বা সেন্স খাটানোর সময় নেই। এ যুগেও কোনো সাংবাদিকের এমন ভুল সত্যিই মর্মান্তিক।

ধর্ষণের অভিযোগই কি শেষ কথা?

সবসময় কথিত ‘ধর্ষক’ বা ‘নিপীড়কের’ নাম প্রকাশ করাও উচিত কিনা, এটাও ভেবে দেখা দরকার। সবক্ষেত্রে তো অভিযোগই শেষ কথা হতে পারে না। স্রেফ অভিযোগের ভিত্তিতেই তার নাম প্রকাশ করার মাঝেও নিরপরাধকে সামাজিকভাবে হেয় করার ক্ষীণ একটা ঝুঁকি থেকে যায় বৈকি। সুতরাং অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে কিঞ্চিত সন্দেহ থাকলেও কাউকে কাগজেকলমে পুরোপুরি ধর্ষক বানিয়ে না ফেলাই ভালো।

পুলিশ যেভাবে চায় সেভাবেই কেন?

এক টেলিভিশন টক শো-তে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ডিজিএফআই-এর সরবরাহ করা দুর্নীতির খবর’ যাচাই না করেই প্রকাশ করে ‘বিরাট ভুল করেছিলেন’ বলে আওয়ামী লীগের তোপের মুখে পড়েছেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ৮৪টি মামলা হয়েছে। দেরিতে হলেও ভুল স্বীকারের সাহসিকতা দেখিয়ে মাহফুজ আনাম সাহস নিয়েই আইনি লড়াই লড়ছেন।

জরুরি অবস্থার সেই সময়টায় সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ানক চাপ ছিল। অনেকের মতো মাহফুজ আনামও সেই চাপের কাছে ‘নত’ হয়েছিলেন। তবে সেই তুলনায় অনেক ভালো পরিস্থিতিতেও কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে প্রতিনিয়ত নতি স্বীকার করতে, অতিরিক্ত আপোসকামী হতে দেখা যায়।

ক্রসফায়ারের খবরে তো তবু কৌশলে বোঝানো হয় যে, ‘বন্দুকযুদ্ধের’ বিবরণটি সম্পূর্ণ ব়্যাব বা পুলিশের দেয়া, কিন্তু যখন ধৃত ব্যক্তিদের বুকে ‘চোর’, ‘ডাকাত’, ‘আদম পাচারকারী’ বা অন্য কোনো অসম্মানসূচক শব্দ লিখে হাজির করা হয়, তখন সেই অবস্থার ছবি হুবহু কেন প্রকাশ করতে হবে? অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই কাউকে এভাবে ‘চোর’, ‘ডাকাত’ বানানোয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার কী আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি আছে?

ভোটকেন্দ্রের ছবিতে শাখা-সিঁদুর পরা হিন্দু নারী থাকতেই হবে?

ভোট কেন্দ্রের ছবি মানেই ভোটারদের লম্বা লাইন এবং সেই লাইনে শাখা এবং সিঁদুর পরা এক বা একাধিক হিন্দু নারী দাঁড়ানো। দেশের সব দৈনিকেই এই নিয়মই প্রতিষ্ঠিত৷ এই নিয়ম অনুসরণ করতে গিয়ে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকও ফটোশপে ছবি বানিয়ে প্রকাশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন ছবি থাকতেই হবে কেন? খবরের কাগজগুলোতে কোনো প্রদর্শনীর ছবি দেখলে মনে হবে বাংলাদেশে প্রদর্শনীতে শুধু নারীরাই যান। এটাই বা কেমন?

কোনটা প্রচারযোগ্য খবর?

খবরের জন্য এখন সবসময় মাঠে-ঘাটে যেতে হয় না। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে আরাম কেদারায় বসেও সহজেই লিখে দেয়া যায় বড় বড় খবর। রাজন হত্যা থেকে শুরু করে বেশ কিছু খবর তো মূলধারার সংবাদমাধ্যমের আগে সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই আমরা পেয়েছি।

কিন্তু আজকাল নির্ভরযোগ্যতার বাছবিচর ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে ভুল সংবাদ প্রচারের দায়ও নিতে হয়েছে বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমকে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নামও কিন্তু এই তালিকায় আছে। ‘সাংবাদিকের চোখ এবং বিবেচনাবোধ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যা খুশি তাই প্রচার করে দেয়া নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে অনেক ক্ষেত্রে সংবাদের উৎস বা সূত্র ভাবা যেতে পারে, কিন্তু পরিপূর্ণ এবং প্রশ্নাতীতভাবে ঠিক খবরের পরিবেশক ভাবা কখনোই ঠিক নয়।

এক তরফা বা খণ্ডিত বক্তব্য প্রচার

অনেকক্ষেত্রেই বড় বড় ইস্যুতে এক তরফা বক্তব্য প্রচার করতে দেখা যায়। কোনো বিষয়ে পক্ষের বা বিপক্ষের বক্তব্যই প্রচার করা আংশিক সত্য প্রকাশ এবং বাকি অংশের সত্য চাপা দেয়ার শামিল। কারো বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে বিতর্ক জন্ম দেয়ার অভিযোগও আছে সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে। এ সব কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

হাসপাতাল বা দুর্ঘটনাস্থলে ‘উৎপাত

এ বিষয়টি প্রধানত টেলিভিশন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রায়ই দেখা যায় খবর সংগ্রহে হাসপাতাল বা কোনো দুর্ঘটনাস্থলে ক্যামেরাসহ সাংবাদিকদের ছুটোছুটি। এভাবে চিকিৎসা বা উদ্ধারকার্যে সমস্যা তৈরি করা একেবারেই ঠিক নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই সাংবাদিকরা এমন পরিস্থিতিতে রোগী বা দুর্ঘটনাগ্রস্থের স্বার্থ সবার ওপরে রেখেই কাজ করছেন।

ব্যক্তির মর্যাদা, নিরাপত্তা সবার আগে

এ বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগেই অনেক কথা হয়েছে। এসএসসি-তে ‘জিপিএ ৫’ পাওয়া শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি যাচাইয়ের নামে তাদের একরকম নাজেহালই করেছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। প্রতিবেদনটি প্রথমে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ও পরীক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এবং তারপর সাংবাদিকতার মান নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক এবং টিভি চ্যানেলটির বিরুদ্ধে কয়েকটি কিশোরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ভিত্তিহীন বা অযৌক্তিক নয়।

শিক্ষার্থীদের এমন সাক্ষাৎকার প্রচারের আগে তাদের অভিবাবকদের অনুমতি নিলে প্রতিবেদনটি আইন এবং আধুনিক সাংবাদিকতার মানদণ্ডে নিশ্চয়ই উৎরে যেত। সবারই মনে রাখা দরকার যে, শুধু শিশু-কিশোর নয়, যে কোনো ব্যক্তির ‘মর্যাদা রক্ষা এবং তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করাই ‘সুস্থ্ সাংবাদিকতা আর এ সবের গুরুত্ব অস্বীকার করা একেবারেই অমানবিক। (সূত্র: ডয়চে ভেলে)

Share