‘গত সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) ম্যামের ক্লাস ছিল। আমেনা খাতুন ম্যামের স্বামী মারা যাওয়ার পর উনার বদলে আকতার জাহান ম্যাম ক্লাস নিতে শুরু করেছিলেন। সেদিনের ক্লাসে বলেছিলেন, কপি দুটো রাখো, ঈদের ছুটিতে নোট দুটো করে রেখো, সমস্যা হলে ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ো, তারপরও যদি সমস্যা হয়, আমাকে ফোন করো।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলির মৃত্যুর খবর পেয়ে এমনই এক স্ট্যাটাস দেন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষা মোস্তাফিজ রনি।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ম্যাম তো বলেছিলেন ঈদের পর দেখা হবে, তবে কেন এভাবে চুপি করে চলে গেলেন?’
মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের ৩০৩ নং কক্ষ থেকে আকতার জাহান জলি ম্যামের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে সেখানে ওই শিক্ষকের হাতে লেখা একটা সুইসাইড নোট পাওয়া যায়।
বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার রানা জানান, ‘সুইসাইড নোটের লেখা দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা ওনারই হাতে লেখা।’
সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক ও মানিসক চাপের কারণে আমি আত্মহত্যা করলাম। সোয়াদকে (ছেলে) যেন তার বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে সে যেকোনো সময় সন্তানকে মেরেও ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে। আমার মৃতদেহ ঢাকায় না নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেয়ার অনুরোধ করছি।’
বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আকতার জাহানের একমাত্র সন্তান সোয়াদ ঢাকার একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। কয়েক বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয় ওই শিক্ষকের। তার সাবেক স্বামী একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদ। আকতার জাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে একাই থাকতেন।
বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাতিল সিরাজ শুভ জানান, গত দুই দিন ধরে আকতার জাহানের ছেলে সোয়াদ তার মাকে ফোনে পাচ্ছিলেন না। পরে সোয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা এবং তাদের প্রতিবেশী অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপুকে জানান। গোলাম সাব্বির সাত্তার তখন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে তা জানালে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মুজিবুল হক আজাদ খান এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে তার কক্ষের সামনে গিয়ে ডাকাডাকি করেন।
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙে তারা কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে তারা মশারি টানানো এবং আকতার জাহানকে বিছানায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে দ্রুত তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক মশিহুর রহমান বলেন, ‘আকতার জাহানের কক্ষ ভেঙে প্রবেশ করে তার মুখের চারপাশে ফেনা জাতীয় একধরনের পদার্থ দেখতে পাই। তবে সেটা আসলে কী তা ময়নাতদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়।’
এদিকে শিক্ষকের মৃত্যুর পর বিভাগের নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ঈদের ছুটিতে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকেলও প্রিয় শিক্ষক হারানোর বেদনায় কাতর সবাই। ক্যাম্পাস জীবনের ওই শিক্ষকের সঙ্গে জড়িত নানা স্মৃতি-বিস্মৃতি সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিভাগের শিক্ষক সাজ্জাদ বকুল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘তাকে ডাক নাম জলি আপা বলে ডাকলে পছন্দ করতেন না। বলতেন, আমাকে আকতার জাহান আপা বলে ডাকতে। ২০১৫ সালের মার্চে বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ওয়াহিদা সিফাতের মৃত্যুর পর রটানো হয়েছিল আত্মহত্যা করেছে। ৩০ মার্চ লিখেছিলেন, ‘‘Ki korle tumi eta Seefat!! Keno? Keno??’’ সেই সাহসী আপা আর সহ্য করতে পারলেন না। নিজের জীবন শেষ করে দিয়ে নিজের জীবনের অবসান ঘটালেন।’
বিভাগ থেকে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর পাশ করা শিক্ষার্থী হালিমা খুশি শোকাতুর হয়ে বলেন, ‘কী নিঃসঙ্গ ছিলেন ম্যাম। সব সময় আমাদের সঙ্গে মজা করতে পছন্দ করতেন। আমরা সবাই সার্টিফিকেট তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো শুনে কী যে খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমরা যেন তাকে সঙ্গে নিয়ে যাই।’
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খাইরুল ইসলাম তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘যিনি আমাদের হাতে কলমে রিপোর্ট শিখিয়েছেন। এর দেখভাল করেছেন। আর আজ তার মৃত্যুর খবর লিখতে হচ্ছে তারই শিক্ষার্থীকে।’
দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জয়শ্রী রাণী সরকার লেখেন, ‘গত ৪-০৯-২০১৬ তারিখে ক্লাসে শিখিয়েছিলেন কীভাবে কারো মৃত্যু সংবাদ লিখতে হয়! আজ ওনার মৃত্যুর সংবাদ পড়তে হচ্ছে!!! (জাগোনিউজ)