বিশেষ সংবাদ

সবুজ গাড়ির ভিতর বাড়ি !

সিএনজিতে উঠেই মনে হলো ভুল করে কোনো ড্রেসিং রুমে ঢুকে পড়েছি। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হলো না, এটা হয়তো কোনো ড্রয়িং রুম। কিন্তু এতেও মনের খুঁতখুঁত থামল না। পরক্ষণে মনে হলো কোনো ছাদ বাগানে উঠে পড়েছি। ভালোভাবে এদিক-ওদিক তাকানোর পর সেটা ভেবেও আর মনকে তৃপ্তি দিতে পারলাম না। স্থান নিয়ে এই টানাপড়েনের উপযুক্ত কারণও রয়েছে।

এর আগে, যে সব বৃক্ষবেষ্টিত সিএনজির কথা শুনেছি বা দেখেছি, সেগুলোর বেশিরভাগই জোর দেওয়া হয়েছে গাছ-গাছালির উপর। কিন্তু এটা পুরো আলাদা। কি নেই এই সিএনজিতে। ছাদের উপর নজরকাড়া বাহারি ফুলের গাছ, ভিতরে দামি কাপড়ে মোড়ানো সিট, পেছনে হেলানো কুশন, সেই সঙ্গে দুই পাশে আকর্ষণীয় পর্দা ঝুলানো। রয়েছে আয়না, চিরুনি, পানির ফিল্টার, অগ্নি-নির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার ও মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা। সামনে তাকাতেই দেখা গেল ছোট একটি টেলিভিশন, ডিজিটাল ঘড়ি, সোলার ফ্যান এবং বৃষ্টির মধ্যে যাত্রীদের সুবিধার্থে ছাতার ব্যবস্থাও। এতেই ক্ষ্যান্ত হননি গাড়িটির চালক। জরুরি মুহূর্তে কারও নাম-ঠিকানা লিখে রাখতে কলম, প্যাড ও স্ট্যাপলারও দেখা গেল একটি বক্সে। রয়েছে টিস্যু বক্স, ম্যাচলাইট এবং নেইল কাটার। এছাড়া গাড়িচালক যেখানে বসেছেন তার পাশেই একটি পাতাবাহারের টব এবং টুকটাক শো-পিস রয়েছে। এতো গেল চারপাশের অবস্থা। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখা মিলল সোলার লাইটের।

এতক্ষণ ধরে যে সিএনজির বর্ণনা দেওয়া হলো তার চালক তপন চন্দ্র ভৌমিক। জানতে চাইলাম, এতকিছু রক্ষণাবেক্ষণ করেন কিভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘অনেকটা সৌখিনতার বশে এসব করে যাচ্ছি। লাভ-ক্ষতির হিসাব করি না।’ মুখের কথা শেষ না হতেই প্রশ্ন ছুড়লাম, বেশ কিছুদিন আগে টেলিভিশনে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে যে সিএনজিকে দেখানো হয়েছিল এটাই কি সেটাই? কিছুক্ষণ থেমে অনেকটা আক্ষেপের সুরে ভৌমিক বলেন, না। ওই সিএনজিতে যা যা ছিল তার তিন গুণ জিনিসপত্র রয়েছে আমার গাড়িতে। হয়তো আমারই দুর্ভাগ্য, সেই ম্যাগাজিনে আমি যেতে পারিনি।’

পরিবারে আর কে কে আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকার খিলগাঁওয়ে থাকি। ছেলে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন। আর মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার সন্তানরা চায় না আমি সিএনজি চালাই। কিন্তু এটাই আমার নেশা। গত ১০ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছি।’ এর আগে কি করতেন? প্রশ্নের জবাবে ভৌমিক বলেন, ‘পড়াশুনা খুব একটা করতে পারেনি। আমি স্বর্ণের কারিগর ছিলাম। চোখের একটা সমস্যার কারণে সেই পেশায় থাকতে পারিনি। তাই এখন সিএনজি চালাই।’

সিএনজি চালিয়ে দিনে আয় কেমন থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্য সিএনজি চালকের তুলনায় আমার আয় অনেক কম। কারণ এগুলোর পরিচর্যার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক বেশ কিছু খরচ আমাকে করতে হয়। তাতে আমার কোনো অসুবিধাও নেই। আমি সিএনজিকে সাজিয়েছি নিজের শখ পূরণ আর যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে। কথায় কথায় দুপুরের ভ্যাপসা গরমে সোলার ফ্যানের ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগিয়ে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। নেমে ভাড়া মিটিয়ে পেছনে ফিরতেই ডেকে ওঠেন তপন।‘স্যার আপনার একটা কার্ড হবে।’ কথাটার শেষে তার মুখে ফুটে ওঠে স্মিত হাসি। ‘আসলে আমার আরেকটি শখ হলো আমার গাড়িতে যেসব যাত্রী ওঠেন তাদের ভিজিটিং কার্ড থাকলে তা সংগ্রহে রাখা। কথাটা শুনে লোকটার প্রতি কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। তার কার্ডের সংগ্রহ দেখতে গিয়ে তো ‘চক্ষু চড়ক গাছ’। কোম্পানির সিইও থেকে শুরু করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী এমনকি বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের ভিজিটিং কার্ডও সংগ্রহে আছে তার। আজ তার সংগ্রহে আরও একটি কার্ড বাড়ল সেটা আমার। কেউ যত্ন করে ভিজিটিং কার্ড সংগ্রহ করে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। বিদায় জানিয়ে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথ ধরলেও মাথায় ঘুরতে থাকল সবুজে বেঁচে থাকা চিরসবুজ এই সিএনজি চালকের কথা।

বার্তা কক্ষ

Share