জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাম্পªতিক এক হিসাবে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। শীর্ষ ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন ও ভারত। একসময় শাকসবজি উৎপাদন দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখন সারা বছর সবজি উৎপাদনের এত বৈচিত্র্য ছিল না। আগে সারা বছর চাষ উপযোগী সবজির উন্নত জাতের বীজের সংকট ছিল। বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোর সারা বছর চাষ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড বীজ উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণ সবজি চাষের সে সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০ ধরনের ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার এ সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। আজ থেকে ২০ বছর আগে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ গ্রামে।
দ্রুত নগরায়ণ, শিক্ষা, মাথাপিছু বার্ষিক আয়, স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি এবং খাদ্যাভ্যাস ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বাড়ছে সবজি ভোগের পরিমাণ ও উৎপাদন। কৃষি সম্পªসারণ অধিদপ্তরের মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮ লাখ ৬১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি থেকে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়।
উৎপাদিত মোট সবজির মধ্যে শীতকালে উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৮ লাখ ৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন এবং গ্রীষ্মকালে উৎপাদিত হয় ৫১ লাখ ৪৮ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ মোট সবজির শতকরা ৬৭ ভাগ উৎপাদিত হয় শীতকালে এবং বাকি ৩২ ভাগ উৎপাদিত হয় গ্রীষ্মকালে ।
অল্প সময়ে অধিক লাভ হওয়ায় সবজি চাষে এগিয়ে আসছেন দেশের শিক্ষিত তরুণরা। তাদের কেউ কেউ বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সাহসী ভূমিকাও পালন করছেন। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের সহযোগিতা করছে প্রযুক্তি দিয়ে, উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য প্রদান করে। সম্পªতি (০৬.১২.২০১৯) নিরাপদ শাকসবজি নিয়ে রাজধানীতে চালু হলো ‘কৃষকের বাজার’। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউর সেচভবন প্রাঙ্গণে কৃষকের বাজার উদ্বোধন করেন কৃষিমন্ত্রী ড.আবদুর রাজ্জাক।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘কৃষকের বাজারে যে সবজিচাষিরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের আমরা এক বছর ধরে প্রস্তুত করেছি। সম্পূর্ণরূপে কীটনাশকমুক্ত সবজি এখানে নিয়ে আসবেন তারা। আজকের এ বাজারকে একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হলো। এটি একটি পাইলট প্রজেক্ট। যদি সফল হয়, আ‡স্ত আ‡স্ত আগামী বছর অনেক কৃষক এ রকম নিরাপদ সবজি উৎপাদন করবেন এবং বাজারজাত করার সুযোগ পাবেন।
আজকের এ বাজারের সফলতার ওপর নির্ভর করে আগামীতে আরও বড় পরিসরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এ রকম বাজারের আয়োজন করা হবে। সারা বছর যাতে এ বাজার চালু থাকে তার সুব্যবস্থাও করা হবে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ছিল। সেই লক্ষে¨ নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার কীভাবে উৎপাদন করা যায়? কীভাবে তা মানুষের মধ্যে সরবরাহ করা যায়? সেটি দেখানোর জন্যই কৃষকের বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঢাকা শহরে প্রায় দেড় কোটি লোকের বাস। এই ছোট্ট বাজার থেকে সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। চাষিরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছেন।
সবজিচাষিরা বলছেন, তারা রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সার ব্যবহার করছেন। পোক-মাকড় দমনের জন্য কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করছেন না। এই বার্তাটি ‘কৃষক বাজারের’ মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে চায় কৃষি বিভাগ। এ রকম বাজার দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও এ খাতে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। সবজি বিপণনে আধুনিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কার্যকর ব্যবহারের অভাবে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। অন্যদিকে কৃষকের মজুদ অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা কম দামে কিনে নিচ্ছেন কৃষিপণ্য।
একজন সুস্থ-সবল মানুষের প্রতিদিন ২২০ গ্রাম করে বছরে কমপক্ষে ৮০ কেজি সবজি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু আমরা সেখানে গ্রহণ করছি প্রতিদিন ১৬৬ গ্রাম করে বছরে সাড়ে ৬০ কেজি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সবজি পরিভোগের পরিমাণ আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি। জাপান, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রতি বার্ষিক সবজি ভোগের পরিমাণ যথাক্রমে ১০০,৯২ ও ১১৬ কেজি।
শাকসবজিতে আমিষ, শর্করা ও চর্বি ছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন। শাকসবজি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে শাকসবজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রঙিন ও সবুজ শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন-এ, যা শিশুদের অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করে। শাকসবজি এসব গুণাগুণের কোনো মূল্য নেই,যদি তাতে থাকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ, যা মানবদেহে বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষে ভরা এসব শাকসবজি খাওয়ার জন্য যদি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়, মানুষের হাত-পা অবশ হয়ে যায়, মানুষ পেটের পীড়ায় ভোগে, তাহলে মানুষ কেন পকেটের পয়সা খরচ করে, এসব বিষাক্ত শাকসবজি কিনে রোগব্যাধিকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে ডেকে আনবে?
জাপানে আমাদের দেশের চেয়ে তিন গুণ বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেখানকার কৃষকরা অত্যন্ত সচেতন। তারা সঠিকমাত্রায় সঠিক বালাইনাশক ব্যবহার করেন এবং অপেক্ষমাণ সময় অতিক্রমের পরই শাকসবজি উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করেন। ফলে ওইসব সবজি খেয়ে ভোক্তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। আর আমাদের দেশে ঘটে তার উল্টো ঘটনা।
কীটনাশক প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই সবজি তুলে বিক্রি করেন কৃষক। কীসের আবার অপেক্ষমাণ সময়। এ দেশের অধিকাংশ কৃষক বালাইনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে শস্যক্ষেতে বালাইনাশক ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে যারা বালাইনাশকের ব্যবসা করেন, তাদের অধিকাংশেরই কৃষি-সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তারা ফসলের পোকামাকড়, রোগবালই ও আগাছা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। রোগ ও পোকা আক্রমণের লক্ষণ সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ।
কৃষক বালাইনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেন। যেসব পোকামাকড় অতি সহজেই হাতেনাতে কিংবা কৃষিতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে দমন করা যায়, সে ক্ষেত্রেও কীটনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে কৃষক অধিকমাত্রায় ক্ষতিকর কীটনাশক প্রয়োগ করেন। কীটনাশকের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা না করে অপেক্ষমাণ সময় শেষের আগেই শাকসবজি তুলে বাজারে বিক্রি করেন কৃষক। ওইসব বিষমিশ্রিত শাকসবজির কারণেই দেশে ক্যানসার, প্যারালাইসিস, কিডনিরোগ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
বালাইনাশকের নির্বিচার ব্যবহারে মানুষই শুধু দুরারোগ্য ব্যাধিতেই ভুগছে না, ধ্বংস হচ্ছে উপকারী বন্ধু পোকা। পোকার দেহে সৃষ্টি হচ্ছে কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা। কীটনাশকের কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। ধ্বংস হচ্ছে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী অণুজীব ও কেঁচোর মতো উপকারী প্রাণী। মাটি হারাচ্ছে সহজাত উর্বরতা। বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ বৃষ্টি ও সেচের পানিতে চুইয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক জলাশয়, নদী-নালা ও খালবিলে। ধ্বংস হচ্ছে জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ। বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে কৃষি।
এসব সমস্যা সমাধানে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও কৃষক বাজারে তা বিক্রির ব্যবস্থা হতে পারে একটি সঠিক ও যুগোপযোগী সমাধান। এ জন্য রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈবসার ও জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে কৃষিতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে এবং হাতেনাতে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থার ব্যবহার।
সে সঙ্গে প্রত্যেক সবজিচাষির বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট ও ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পোকামাকড় ও ইঁদুর দমনে বিভিন্ন ফাঁদ, বিশেষ করে ফেরোমনফাঁদ, আঠাফাঁদ ও হলুদফাঁদ ব্যবহারেও কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তুলনামূলকভাবে জৈব বালাইনাশকের দাম বেশি এবং সেগুলো রাসায়নিক বালাইনাশকের মতো গ্রামের হাটবাজারে সহজলভ্য নয়। তাই জৈব বালাইনাশকের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয়কে।
কৃষক যাতে তার হাতের কাছে সহজে জৈব বালাইনাশক পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে দেশের বালাইনাশক কোম্পানিগুলোকে। প্রয়োজনে রাসায়নিক সারের মতো জৈব সারেও সরকারি ভতুকি প্রদান করতে হবে। কমাতে হবে জৈব সারের দাম। জৈব সার ও কীটনাশকের ব্যবহার-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপক প্রচার ও কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে স্বল্প ভাড়ায় সবজি পরিবহন ও সড়কপথে সবজি পরিবহনের ক্ষেত্রে সব চাঁদাবাজি বন্ধের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব কর্মকাণ্ড ছাড়া শুধু ‘কৃষকের বাজার’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিরাপদ ও পুষ্টিকর শাকসবজি উৎপাদন, ব্যবহার ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রদানের উদ্দেশ্য কোনো অবস্থাতেই সফল হবে না
নিতাই চন্দ্র রায় ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯