প্রকাশের সময় : Saturday, April 25, 2015 09:22:23 PM
শান্তিপুরের রাজা, নিজের মতো করে রাজ্য পরিচালনা করছেন। যার কারনেই হয়তো শান্তিতে আছে রাজ্যের সব প্রজারা। রাজার প্রতি কারো কোন অভিযোগ নেই। নেই কোন জগড়া বিবাদ। হঠাতই একদিন শুনা গেলো রাজা তার কক্ষে খুন হয়েছেন। কেউ বলছে খুন আবার কেউ বলছে এটা আত্মহত্যা। কোন সঠিক খবর সেটা কেউ জানেনা। চারিদিকে শুধু কান্নার শব্দ, রাজ্যোর সবার মুখে কান্নার একই সুর। “হায় রাজা আপনি এটা কি করলেন, আমাদের সবাইকে ছেড়ে আপনি চলে গেলেন। এখন কে দেখবে আমাদের, কে পরিচালনা করবে আমাদের এই দেশ, কে আমাদের দুঃখে পাশে দাঁড়াবে” রাজ্যে সকলের কান্না থামার পর নতুন করে সবাই বলাবলি করতে লাগলো “রাজা এতো ভালো মানুষ ছিলেন, এতো বিচক্ষন ছিলেন তাহলে আমাদের রাজা আত্মহত্যা কারেতে গেলেন কেনো? নাকি এর পেছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে। যদি কোন ষড়যন্ত্র থেকেই থাকে তাহলে কে করলো এ ষড়যন্ত্র? রাজ প্রাসাদের কেউ নয়তো?”
রাজার যেহেতু রাজ্য পরিচালনা করার জন্য কোন উত্তরসুরি রেখে যাননি সেহেতু সর্বসম্মতি ক্রমে রাজ্য পরিচালনা করার দায়িত্ব রাজার ছোট ভাই এর উপর পড়লো। রাজা আর রাজার ভাই যেহেতু একই রক্তের সেহেতু বর্তমান রাজাও আগের রাজার মত করেই সবার মন জুগিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। রাজ্যের প্রজারাও শান্তিতে দেশে বসবাস করতে লাগলো। অশান্তি শুধুই নতুন রাজার মনে, কেননা তিনি এখনো বের করতে পারেননি তার ভাইয়ের খুন বা আত্মহত্যার কারন। এতো এতো পাহারার মধ্যে কে রাজাকে খুন করলো, কেনইবা খুন করলো। রাজারতো কোন শত্রু ছিলোনা। আর যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তাহলে কেনইবা তিনি আত্মহত্যা করলেন।
ছোট রাজা একদিন ওনার ঘরে প্রধান বিচারপতি অর্থাৎ হাকিম সাহেবকে ডেকে এনে ওনার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচানা করলেন। তিনি চাইছেন যে, কে এবং কেন আমার ভাইকে খুন করলো। আর যদি তিনি আত্মহত্যাই করে থাকেন তাহলে কি তার কারন।
– হাকিম সাহেব, আপনি আনেক দিন ধরেরই এই রাজ্যের বিচার কার্য চালিয়ে যাচ্ছেন, আমি জানি আপনি অনেক বিচক্ষন ও বিজ্ঞ। আপনি কি বলতে পারবেন রাজা খুন হওয়ার কারন? আর যাদি এটা আত্মহত্যাই হয়ে থাকে তাহলে আপনি কি রাজার মাঝে এমন কিছু লক্ষ করেছেন, যে কারনে তিনি আত্মহত্যা করেছেন?
– না হুজুর আমাদের রাজা খুন হননি, রাজদরবারের যে কড়া পাহারা তাতে আমাদের রাজা কোন ভাবেই খুন হতে পারেননা। আর যাদি আত্মহত্যার কথা বলি তাহলে আমি বলবো আমি তোমন কিছু দেখিনি, তবে উনি মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই কেমন যানি একটু বিষ্যন্নতায় একা একা সময় কাটাতেন, সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকতেন। ঠিক মতো রাজ্য সভায় আসতেননা। যদিও আসতেন বেশিক্ষন থাকতেননা। তাবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের রাজা খুন হননি।
– তা কি কারনে ওনার মন খারাপ থাকতো, সেটা বলতে পারবেন?
– না হুজুর, সে ব্যাপারে উনি কাউকেই কিছু বলে যাননি। আপনি বরং আমাদের রানি মাকে জিজ্ঞেস করুন, উনি হয়তো কিছু একটা বলতে পারেন।
– না, এ ব্যাপারে ওনার কাছ থেকে জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। রাজার মৃত্যুতে উনি মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন, তাছাড়া উনি এখন গর্ভবতি। তাই আমি চাইনা এই মুহুর্তে এসব কথা বলে ওনাকে আরো মানোসিক চাপের মধ্যে ফেলি। আপনি বরং একটা কাজ করুন। আপনি সহ রাজ্যের আরো কয়েকজন বিজ্ঞ লোকদের নিয়ে আমার ভাইয়ের হত্যা বা আত্মহত্যার কারনা বের করুন। যত ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হয় আমি করবো।
– জো হুকুম হুজুর।
– আপনি তাহলে এখন থেকেই কাজ আরম্ভ করুন।
– রাজা মশাই, আপনি দারোয়ান কে বলে দিন যেন, এখন থেকে প্রসাদের কেউ যেনো আমাদের বড় রাজার ঘরে প্রবেশ না করে, মানে যে ঘরে রাজা থাকতেন।
– আচ্ছ আমি বলে দিচ্ছি, আপনি এখন আসতে পারেন। আর যত দ্রুত সম্ভব আপনি আপনার কাজ আরম্ভ করুন।
নতুন রাজার দায়িত্ব পেয়ে হাকিম সাহেব পড়ে গেলেন মহা চিন্তায়। চিন্তা করেও লাভ নেই, রাজার আদেশতো পালন করতেই হবে। হাকিম সাহেব নেমে গেলেন মাঠে আর খুঁজতে লাগলেন রাজ্যের এমন কিছু বিচক্ষন মানুষ, যারা তাকে তার অনুসন্ধানি কাজে সাহায্য করার যোগ্যতা রাখে। পেয়েও গেলেন এমন চার জনকে। এর মধ্যে একজন রাজদরবারের প্রধান শিক্ষক, একজন পেশাদার জুয়াড়ি, একজন পেশাদার চোর আর একজন রাজদরবারের নরসুন্দর। হাকিম সাহেব তার কাজের সুবিদার্থে ঐ চার জনের কাজে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বললেন। ওনারা বিচারপতির সাথে থেকে সাহায্য কারার কাথা দিয়েছে। রাজ প্রাসাদে ফিরে হাকিম সাহেব নতুনরাজাকে ঐ চার জনের পেশা সহ পরিচয়টা তুলে ধরে বললেন।
– হুজুর আপনি অনুমতি দিলে আমরা আজকেই আমাদের কাজ আরম্ভ করতে পারি।
– আপনার উপর আমার অঘাত বিশ্বাস আছে হাকিম সাহেব। তাই ওনাদের পেশা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। আপনি আপনার কাজ আরম্ভ করতে পারেন।
– জ্বি হুজুর আপনি এখন অনুমতি দিলে দারোয়ানের কাছ থেকে আমি রাজার কক্ষের চাবিটা নিতে পারি।
– আমি দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি।
আত্মহত্যার কারন উৎঘাটনের দায়িত্ব এখন পাঁচ চরিত্রের পাঁচ জনের উপর। পাঁচ জন পাঁচ চিন্তাধারার মানুষ। তাই তারা প্রত্যেকে রাজার কামরায় প্রবেশ করে ওনাদের সেই আলাদা চিন্তা চেতনাকে কাজে লাগিয়ে দেখতে লাগলেন কামরার প্রতিটা কোন। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলেন পড়ে থাকা বালিকনা থেকে শুরু গচ্ছিত প্রতিটি আসবাব পত্র। কোন কিছুই আর বাদ দিলেন না কেউ। অনেক খোঁজা খুঁজির পার নরসুন্দর এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা কিছু চুল সংগ্রহ করলেন। আর প্রধান শিক্ষক খুঁজে পেলেন রাজার ব্যাবহারিক কিছু কাগজ পত্র। চোর আর জুয়ারি তেমন কিছুই খুঁজে পেলেন না। সারাদিন এরকম খোঁজা খুঁজির পর হাকিম সাহেব সবাইকে নিয়ে বসলেন, কাজের পর্যালোচনা করতে। হাকিম সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন। “তা আপনারা কে কি খুঁজে পেলেন?”
নরসুন্দরঃ হাকিম সাহেব আপনাকে আর কি বলবো, আপনিতো জানেনই আমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রাজপরিবারের সকলের মাথার চুলে কেটে আসছি। রানির চুলের সাথে জড়ানো এমন কিছু চুল পেয়েছি যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এ চুল আমাদের বড় রাজা বা রানির নয়। তাহলে নিশ্চই রাজার ঘরে তৃতীয় কোন ব্যাক্তি প্রবেশ করেছিলো। তাই আমার মনে হচ্ছে আমাদের রাজা খুন হয়েছেন আত্মহত্যা নয়। আমি রানির চুল আর অন্য চুল গুলো আলাদা করে রেখেছি।
চোরঃ আমি অনেক দিন ধরেই চেস্টা করেছি রাজার কক্ষে চুরি করতে। প্রত্যেকবারই ব্যার্থ হয়েছি। শেষ যেদিন রাজার কক্ষে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছি। সে দিনই আমি রাজার হাতে ধরা পড়েছি। রাজা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাই আমার চাইতে ভালো ভাবে কেউ বলতে পারবেনা রাজার এই কক্ষে প্রবেশ করার গোপন রাস্তাটা কোথায়? তাই আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি আমাদের রাজাকে কেউ হত্যা করেনি, রাজা আত্মহত্যাই করেছেন।
শিক্ষকঃ রাজ দরবারে থাকাকালিন সময়ে রাজা আমাকে দিয়ে বিভিন্ন কাব্য লিখিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজাদের কাছে পাঠাতেন। আর আমাদের বিচক্ষন রাজা ধিরে ধিরে তা আয়ত্ত করে নিয়েছেন। রাজা কক্ষে আমি অনেক কিছুই খুঁজে পেয়েছি কিন্তু এর মধ্যে যে গুলো আমার কাছে গুরুত্বপুর্ন মনে হয়েছে তা হলো, রাজার হাতের লেখা একটা কবিতা, আর কিছু তাস। তাসের সম্মন্ধে আমার তেমন কোন ধারনা না থাকায় কবিতাটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিন। বুঝলে হয়তো বলতে পারবো রাজা খুন হয়েছেন নাকি আত্মহত্যা করেছেন।
জুয়ারিঃ আমি তেমন কিছুই পাইনি, তবে শিক্ষক মশাই যেহেতু কিছু তাস সংগ্রহ করেছেন, তাহলে তাসগুলো আমাকে একটু দেখতে হবে।
শিক্ষক মশাই জুয়ারিকে তাস গুলো দেখালেন। জুয়ারি দেখলেন সেখানে ৫২টা তাসের মধ্যে ১২টা তাস রয়েছে। যা তাসের ইস্কাবন, চিরে, রুহিতন, ও হরতনের রাজা, রানি ও গোলাম। শিক্ষক সাহেবকে বললেন, আপনি কবিতাটা পড়–ন, দেখি সেখানে তাসের কথা কি লিখা আছে। শিক্ষক মশাই কবিতাটি পড়তে লাগলেন।
“এখানে আছে যাহা,
দেখো রাজা রানির কি সংসার আহা।
কি কারনে ভাংলো তাহা?
কারনটা পাবে যার জ্ঞান মহা।
ইস্কাবনের রাজাকে রাখো সবার উপরে।
ডানে রানি আর গোলাম কে রাখো পর পর করে।
বুঝিতে পারোকি কিছু?
যদি না পারো রুহিতনের রাজাকে রাখে ইস্কাবনের রাজার নিচু।
রানি আর গোলাম রবে আগের সারির মত,
এবার নিচে সাজাও চিরের রাজা, রানি আর গোলাম আছে যত।
হরতনের গোলাম রাখো নিচের সারির বাঁ পাশে।
রানিরে রাখো তার ডানে, রনি নিত্য যেথায় বসে।
রানির ডানে বসিয়া রাজা জানলো রানীর গর্ভে গোলামের পুত্র সত্তা।
তা শুনে হরতনের রাজা দেখো করেছে নিজেকে হত্যা।
শুনিয়া লও শেষ বানি।
গোলামের পাপ নেই, কারন প্রথমে ফুল দিয়ে অন্যায়টা করেছেযে রানি।
বিশ্বাস না হয় দেখো, রুহিতনের রানির হাত খানি।”
জুয়াড়ি আর শিক্ষক মশাই মিলে কাব্যের ভাষায় ভাষায় মিলিয়ে ১২ টি তাস সাজালেন। অবাক করার বিষয়, উপস্থিত সবাই সাজানো তাস গুলোর রাজা রানি আর গোলামের চেহারার দিকে তাকিয়ে রাজা রানির ভালোবাসা আর বিচ্ছেদের আভাস পেলেন। পারদিন সকাল বেলায় হাকিম সাহেব শিক্ষক, নরসুন্দর, চোর আর জুয়াড়ীকে নিয়ে হাজির হলেন রাজ দরবারে।
– জ্বি হুজুর আমরা বের করতে সক্ষম হয়েছি যে, বড় রাজা খুন হননি তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
– কি কারন, কার কারন?
– আমাদের রানির আর ওনাদের কক্ষ পাহারাদারের কারন। তবে হুজুর সাবধান, রানিকে এই মুহুর্তে কিছুই বলা যাবেনা, উনি আগে সুস্থ হোক তারপর ওনাকে জিজ্ঞেস করা যাবে। তার আগে আমাদের রাজার কক্ষ পাহারাদারকে একটু খবর দিন, দেখি খুঁজে পাওয়া চুলগুলো ঐ গোলামের সাথে মিলে কি না।
রাজার হুকুমে পাহারাদারকে ডেকে আনা হলো। চুল গুলোও মিলিয়ে দেখা হলো। মিলেও গেলো। কিন্তা এব্যাপারে পাহারাদারকে কিছুই বুঝতে দেয়া হলোনা। রাজার লেখা কাব্যের সাথে তাস গুলো মিলিয়ে রাজাকে দিখিয়ে শিক্ষক মশাই বললেন। রাজা মশাই তাস গুলো দিকে লক্ষ করলে দেখবেন।
প্রথম সারিতে, রাজা আর রানির সুখের সংসার, কিন্তু রাজার যেখানে হাসি মুখে, রানির সেখানে গোমরা করে বসে আছেন। আর দেখুন গোলামের দৃষ্টি আমাদের রানির উপর।
দ্বিতীয় সারিতে, রাজা যখন রাজদরবার নিয়ে ব্যস্ত, রানি তখন ফুল হাতে গোলামের দিকে। তখন গোলাম অবশ্য রানির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে।
তৃতীয় সারিতে, রাজা যখন সেই রাজদারবার নিয়েই ব্যস্ত, সে সুযোগে রানির ডাকে গোলামের তখন সায়।
চতুর্থ সারিতে, রানি তার গোলামকে পুরুষত্বের দিক থেকে ঠিক রাজার যায়গায় বসালেন। মানে তখন রানির গর্ভে গোলামের সন্তান, তাছাড়া রাজাও বুঝতে পারলেন যে তিনি ঠিক মতো রানিকে সময় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই রানি এ পথে পা বাড়িয়েছে। ঠিক তখনই আমাদের রাজা মনের কষ্টে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। কিন্তু রাজা মশাই রাজা তার কবিতায় আর তাসে গোলামের শাস্তির ব্যাপারটাও সুনজরে দেখতে বলেছেন।
রাজা সবাইকে সামনে রেখে পাহারাদার অর্থাৎ গোলামকে বদলি করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর রাজা চাইছেন তাদের এই অনুসন্ধানিটি আর এর ফলাফলটি রাজ্যের অন্যকেউ তো দুরের কথা রানিও যেনো না জানে। জানলে হয়তো অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনিও আত্মহত্যার পথ বেছে নিবেন। উপস্থিত সবাই রাজার কথায় সায় দিলেন এবং যে যে যার যার কাজে চলে গেলেন।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/ডিএইচ/2015
নিয়মিত আপনার ফেসবুকে নিউজ পেতে লাইক দিন : https://www.facebook.com/chandpurtimesonline/likes