বুধবার, ১০ জুন ২০১৫ ০৯:০২ অপরাহ্ন
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট :
সন্তান বিয়ে দিয়ে আর নাগরিকত্ব নিতে হবে না ছিটমহলবাসীকে। ছেলেমেয়েকে স্কুলে কিংবা স্বজনদের হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রেও আর মিথ্যা তথ্য দিতে হবে না তাদের। দীর্ঘ ৬৮ বছরের দুঃসহ নাগরিক অধিকার বঞ্চনার শিকার অর্ধ লক্ষাধিক ছিটমহলবাসীর দুর্দশার অবসান ঘটছে। আগামী ৩১ জুলাই মধ্য রাত থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় শুরু হবে। গত ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত নথিপত্র বিনিময় করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান নামে আলাদা দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এরপর থেকেই ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মধ্যে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন মোট ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে ছিটমহল বিনিময়ে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তবে দীর্ঘ দিনেও এই চুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ২০১১ সালে এ বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষর হয়।
শুরু থেকেই ছিটমহলবাসী মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন। এ সব ছিটের বাসিন্দারা শিক্ষা-দীক্ষা-উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত তো বটেই, বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ থেকেও বঞ্চিত রয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারেন না। কেউ কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে কিংবা স্থানীয়ভাবে নানা তদবির করে ছেলেমেয়েদের স্কুল-মাদরাসায় ভর্তি করে থাকেন। সবচেয়ে অমানবিক দিক হল ছিটের বাসিন্দারা জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হলেও কোনো সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ছিটের বাসিন্দাদের।
নাগরিক অধিকার বঞ্চিত ছিটমহলবাসীর অনেকেই নানা কৌশলে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে তাদের সন্তানদের বিয়ে দিয়ে নাগরিকত্ব নিতেন।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের দক্ষিণ গুতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা সত্তর বছর বয়ষ্ক বৃদ্ধ মো. ছকবর আলীর ছিটমহলে তাঁর জন্মের পর থেকে চলা দুঃসহ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয় প্রতিবেদকের। কথায় কথায় তিনি তার ৭০ বচরের জীবনে ছিটমহলে কাটানোর দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরেন চাঁদপুর টাইমস-এর কাছে। ওই সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বড় হলেও দীর্ঘ ৭০ বছরের জীবনে তার বাপ-দাদার মতো বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেননি। তার ২ ছেলে ও ৫ মেয়ের জীবনও সেদিকেই যাচ্ছিল। তাই নানা কৌশল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের সবাইকে বাংলাদেশের মূল ভুখণ্ডে বিয়ে দিয়েছেন। ছকবর নিজে বাংলাদেশের নাগরিক না হলেও ছেলেমেয়েরা বিবাহ সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। তার বড় ছেলে আবুল কালাম আযাদকে ছকবর আলী তার ভগ্নিপতির বাড়িতে রেখে এবং তাকে বাবা সাজিয়ে স্থানীয় (হাতীবান্ধা উপজেলার) দই খাওয়া আলিম মাদরাসায় ভর্তি করান। আযাদ এখন ওই মাদরাসারই শিক্ষক। মূল ভূখণ্ডে বিয়ে করার পর আযাদ এখন বাংলাদেশের নাগরিক। তবে, ৫ ছেলেমেয়ে বিবাহ সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বৃদ্ধ ছকবর এখনও নাগরিকত্ব পাননি।
কথা হয় বৃদ্ধ ছকবর আলীর সঙ্গে। তিনি বর্তমানে গুতামারী (১৩৫/১ ও ১৩৫/২) ছিটমহলের সভাপতিও।
ছকবর আলী বলেন, ‘আমরা এতদিন কোনো দেশের নাগরিক ছিলাম না। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এতদিন চলতাম, ছেলেমেয়ে স্কুলে ভর্তি করাতাম। হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে। এখন আর আমাদের মিথ্যা তথ্য দিতে হবে না। আমরা এখন বাংলাদেশী। জীবনের শেষ বয়সে এসে আমি বাংলাদেশের ভোটার হতে পারছি। সে জন্য খুব আনন্দ লাগছে।’
গুতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধা আজিমুন নেছা বলেন, ‘হামা এখন বাংলাদেশী। তাতে মুই খুব খুশি। এত দিন হামা ফকিরের চেয়েও খারাপ ছিনো। ফকিরের দাম আছে তবু হামার দাম ছিল না। যাই হোক মুইতো আর বেশী দিন বাচিম না। তবে মরার আগে ছিটমহল বিনিময় দিখি যাবার পানুং এতয় খুশি। মোর ছেলেমেয়ে ভালভাবে জীবনযাপন করবার পাইলে হইল।’
ছিটমহলের শিশু-কিশোর রানা, আয়নুল, খালেকুল, শাহিনুর, রকিব, সুজন, সার্জিনা, ইয়াসিন- তারা লেখাপড়া করে না। তাদের মতো অনেক শিশু ছিটমহলে রয়েছে। তারা লেখাপড়া করতে চায় কিন্তু ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় তাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি নেওয়া হয় না। আগামী বছরের শুরুতে তারা স্কুলে ভর্তি হবে বলে তারা দ্য রিপোর্টের কাছে ইচ্ছের কথা জানায়।
ছিটমহলের বাসিন্দা ভৈরব চন্দ্র বর্মণ জানান, বাপ-দাদারা মারা গেছেন নাগরিক অধিকার না নিয়ে। বর্তমানে অনেকের বয়স বেড়ে যাওয়ায় তারা প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এ সব বয়োজ্যেষ্ঠের ভাবনা ছিল হয়ত কোনো সুখবর না পেয়েই পূর্ব পুরুষের মতো চলে যাবেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে উত্তরসূরিদের রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিবেন। অবশেষে ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে ও তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাচ্ছেন বলে দারুণ খুশি।
গুতামারী ছিটমল লাগোয়া বাংলাদেশের বাসিন্দা মোক্তার আলীর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ব্র্যাক স্কুল। মোক্তার আলী বলেন, ‘ছিটমহলের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তারা যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় এ কারণেই এ স্কুল করেছি।’
ওই স্কুলের শিক্ষিকা বেবী আক্তার বলেন, ‘এতদিন এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে ভয় পেত। কিন্তু ছিটমহল বিনিময় চুক্তি হবার পরপর তারা এখন প্রতিদিন জাতীয় সঙ্গীত গায়।’
ছিটমহলের আরেক বাসিন্দা বীরেন্দ্র নাথ বলেন, ‘মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আমার মেয়ে রত্নাকে বাংলাদেশে বিয়ে দিয়েছি। সে এখন বাংলাদেশের নাগরিক। পঞ্চাশ বছর বয়সেও আমি বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারিনি। এখন তো আর সমস্যা হবে না। আমিও এখন বাংলাদেশী। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ছেলেমেয়েদের আর আমাদের বিয়ে দিতে হবে না।’
লালমনিরহাট জেলা ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজীজুল ইসলাম আশিক বলেন, ‘আমরা ছিটমহলবাসী দীর্ঘ ৬৮ বছর বন্দী থাকার পর এখন আমরা আলোর মুখ দেখছি। দীর্ঘদিন ধরে আমরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছি। আমরা এখন আমাদের মৌলিক অধিকার পাব। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, অতি দ্রুত যেন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা, গ্রামে স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এতদিন সরকারি সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হয়ে আসছি। বিধবা ভাতা, বয়ষ্ক ভাতা, ছেলেমেয়েদের স্কুলের উপবৃত্তি কোনো কিছুই আমাদের জন্য ছিল না। এখন আর যেন ওই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হই।’
গুতামারীসহ লালমনিরহাটের বিভিন্ন ছিটমহল সরেজমিনে ঘুরে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি, হাসপাতালে চিকিৎসা কিংবা জমির দলিল দস্তাবেজসহ সব কাজে তাদের মিথ্যা ও ভুল ঠিকানা ব্যবহার করতে হতো তাই নয়, কোনো কারণে মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলেই ছিটমহলের বাসিন্দাদের নামে মামলা টুকে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ছিটমহলের বাসিন্দারা বাদী হয়ে মামলা করতে পারে না। দীর্ঘ ৬৮ বছর মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করতে হয়েছে ছিটমহলবাসীকে। এখন আর তাদের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করতে হবে না। আগামী ৩১ জুলাই মধ্য রাত থেকেই ছিটমহলগুলো বিনিময় হবে। নাগরিকত্বের স্বাদ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্ত আকাশে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন ১১১টি ছিটমহলের ৫০ হাজারেরও বেশী বাসিন্দা।
১৯৭৪ সালের ইন্দ্রিরা-মুজিব চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী, ছিটমহলবাসী তাদের পছন্দ অনুযায়ী নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা লাভের অধিকার পাবেন। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পাবে। আর ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৫১টি ছিটমহল ভারত পাবে। তবে, ছিটমহলের বাসিন্দারা ইচ্ছে করলে যেকোনো দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ নিতে পারবেন। তাদের স্থায়ী সম্পদ স্থানান্তর বা বিক্রি করতে চাইলে (প্রকৃত নথিপত্র অনুযায়ী) সংশ্লিষ্ট দেশের জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নেবেন। দুই দেশের সংশ্লিষ্ট জরিপকারী দল মানচিত্রে দুই দেশের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করবে। ছিটমহলবাসীদের সম্পদ স্থানান্তরে কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই দেশের প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী সমাধান করবে।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।