ফিচার

সংসার ভাঙার ভয়ে নারীরা যে বিষয়টি এড়িয়ে যান

একটা নির্মম তথ্য জানলাম। সংসার ভাঙার ভয়ে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক নারী স্বামী কিংবা পরিবারের কাছে তার অসুখের বিষয়টি লুকিয়ে থাকেন।

সেই সাথে কুসংস্কার তো আছেই। এসব কারণে প্রতিবছর নতুন করে যারা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের এক-চতুর্থাংশ চিকিৎসা সেবা নেন না। ফলে আক্রান্তের হার ও মৃতের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে।

এই অসম্ভব বেদনাদায়ক তথ্যটা যখন হজম করার চেষ্টা করছি, সেই সময়ই নায়লা নাইমের আবির্ভাব।

সেই বহুল আলোচিত ভিডিও- যেখানে ক্যান্সারের চেয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে নারীর স্তন আর তার যৌনাবেদন। এখন উপরের এই তথ্য আর নায়লার ভিডিও যারা বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে কোন সংযোগ খুঁজে পান না? এই দুটি ঘটনাই তো একই ভাবনা উৎস থেকে উৎসারিত- দুটিতেই নারী, মানুষের অধিক মাংসপিণ্ড- যা শুধুই যৌনতার কাজে লাগে।

যেসব ‘পণ্ডিত, সৃষ্টিশীল, বিশাল আর্টিস্টিক’ লোকেরা এদেশে বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজে নিয়োজিত, তারাও এই ভাবনার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন এবং তাদের ‘সৃষ্টিশীলতা’ সর্বত্রই নারীর যৌনাবেদনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ফলে স্তনের মধ্যে যৌনতা ছাড়া তারাও আর কিছু খুঁজে পাননি। তাই সেই মাংসপিণ্ডের অসুখও যৌনতা, সেখানে নায়লা নাঈম শার্ট খুলে বাঁকা হাসি দেবেন- এটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা।

তো পাশের দেশ ভারতেও ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতামূলক ভিডিও এসেছে একটি। এখানে যেমন নায়লা, সেখানে সানি লিওন। পার্থক্য? পার্থক্য মগজে, সৃষ্টিশীলতায় আর রুচিবোধে এবং অবশ্যই নারীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির ভিতরে। সেখানে চার শ্রেণি পেশার চারজন পুরুষকে দেখানো হয়েছে, যারা কোনো নারীর সাথে কথা বলার সময় বারবারই তার বুকের দিকে তাকাচ্ছে, যা এই উপমহাদেশের পুরুষেরা হরহামেশা করে থাকে, তা সে যত বড় বিদ্বান আর ভদ্রলোক হোক, কী ট্যাক্সি ড্রাইভার বা বাড়ির দারোয়ান। তো এরপর সানি আসলেন, তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, পুরুষেরা আমাদের স্তনের দিকে যত নজর দেয়, তার কিছুটাও যদি আমরা নারীরা আমাদের স্তনের দিকে দিতে পারতাম তবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রকোপ এই হারে বাড়তো না।

সানি পর্ণগ্রাফি সিনেমার এক সময়ের স্টার, বলিউড কাঁপাচ্ছেন এখন। তাকে দিয়ে যেকোনো দৃশ্যই হয়তো করানো যেত এখানে। কিন্তু যারা এই বিজ্ঞাপনটি তৈরি করেছেন, তারা জানেন এবং বোঝেন ব্রেস্ট ক্যান্সার যৌনতার কোনো বিষয় নয়, নারী অঙ্গ মানেই যৌনতা নয়। তো এই বোধ এদেশের তথাকথিত সৃষ্টিশীল বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের ভিতরে ঢুকতে হয়তো আরো একশ বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। এতোটাই দুর্ভাগা আমরা।

ফিরে আসি প্রথম তথ্যে। নারী সংসার ভাঙার ভয়ে প্রাণঘাতী অসুখের কথা গোপন করে। কারণ অসুখটা হয়েছে তার এমন এক অঙ্গে যা পুরুষের ‘সাধনা, আরাধ্য’- এইসব হাবিজাবি- যা মোঘল বাদশাহ থেকে শুরু করে হরিপদ কেরানি সকলেই বলে এসেছে।
তো সেই আরাধ্য বস্তু পুরুষের নজর থেকে বাঁচাতে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা লাগে, জামার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেলে ‘বেশ্যা’ ডাক শোনা লাগে, ভিড়ের মধ্যে দুই হাত দিয়ে কায়দা কৌশল করে স্তন বাঁচিয়ে হাঁটা-চলা করা লাগে, পুরুষের নজর কাড়তে ভালো ভালো ক্রিম মেখে স্তন সুউন্নত বানানো লাগে, সারাক্ষণ ব্রা পরে থাকা লাগে, যেন স্তন ঝুলে পড়ে পুরুষের চোখে অনাকর্ষণীয় হয়ে না যায়। আমি এমন অনেক মেয়ের কথা জানি, যারা সন্তানকে বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত করেন শুধুমাত্র স্তনের আকার খারাপ হয়ে যাবে এই ভেবে এবং তাতে তাদের স্বামী দুঃখ-কষ্টে সন্ন্যাসী হয়ে বনবাসে চলে যেতে পারেন এই আশংকায়।

তো নারীর জীবনে স্তন একটা বিরাট ফ্যাক্টর। যদিও শারীরিকভাবে শিশুখাদ্য উৎপাদনই এর মূল কাজ, তবু সেসব ছাপিয়ে স্তনের যৌনতাই বড় হয়ে উঠেছে। সে কারণেই এ দেশে সন্তানকে মায়েরা পথেঘাটে, অফিসে, আদালতে, শপিং মলে দুধ খাওয়াতে পারেন না। কারণ স্তন দৃশ্যমান হলে পুরুষের যৌনতার ঢল হুড়মুড় করে নেমে আসে, তা সে কোন মায়ের স্তনই বা হোক না কেন!

এহেন সমাজে স্তন ক্যান্সার মেয়েরা লুকিয়ে রাখবে, কারণ স্তন বিরাট ঘটনা। স্বামী যদি জেনে যায়, তবে তার অসুস্থ অঙ্গটির কারণে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে- এই চিন্তাটি অসুস্থ হলেও, অমূলক নয়। স্বামীদের পক্ষে এটি সম্ভব এবং বাস্তবে নিশ্চয়ই এরকম ঘটে।

আমার ছোটবেলার বন্ধু স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হবার পরও কোনো পুরুষ তাকে বিয়ে তো করেইনি, যে ছেলেটি তাকে কয়েক বছর ধরে প্রেমের কথা বলে আসছিল, অসুখের কথা জানার পর সেও পিঠটান দিয়েছিল। এরকম ঘটনা ভুরি ভুরি আছে।

স্তন এদেশে গোপন ব্যাপার, নিষিদ্ধ ব্যাপার এবং গর্হিত। তাই স্তন প্রকাশ পাবার সাথে সাথে নারীর বুকে জড়িয়ে দেয়া হয় ওড়না, তাকে পিঠ কুঁজো করে হাঁটতে বলা হয়, আন্ডার গার্মেন্টসের দোকানে গিয়ে মেয়েরা আশপাশ দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ব্রা হবে’। দোকানী সরাসরি বুকের দিকে তাকিয়ে হলুদ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, ‘মাপ কতো?’ মেয়ে মরমে মরে গিয়ে বলে, ‘৩৪’। দোকানী বলে, ‘আপনার ৩৬ লাগবে’। বলে আবার তার হলদে দাঁত বের করে হাসতে থাকে।

তো এহেন সমাজে ব্রেস্ট ক্যান্সারও গর্হিত, নিষিদ্ধ, গোপন আর অশ্লীল। মেয়ে ব্রেস্ট চেকআপে যেতে লজ্জা পায়, ডাক্তার দেখাতে লজ্জা পায়, অসুখ হলে স্বামীকে বলতে ভয় পায়, চিকিৎসা নিতে ভয় পায়। ব্রেস্ট ক্যান্সার অনেক নারীর আত্মবিশ্বাসের জায়গাটাও নষ্ট করে দেয়, কারণ শৈশব থেকে তাকে শেখানো হয়েছে তোমার নারীজীবনের পরম সম্পদ হলো তোমার এই দুটি স্তন। এই চরম মিথ্যা আর নোংরা চিন্তাটি তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে ক্রমাগত ব্যবহার করেছে পুরুষ। সেই ব্যবহারই আজ নানা রূপে প্রকাশিত।

একটি পুঁজিবাদী সমাজে নারী পণ্য তার শরীরের জন্য, তার স্তনের জন্য। সেই স্তনের কোমল আবেদনময়ী রূপ নানা কায়দায় দেখিয়ে ফায়দা লোটে পুঁজিবাদ, তাই দেখে তৃপ্ত হয় পুরুষের মন, শরীর। কিন্তু সেই একই স্তন হঠাৎ পোশাকের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেলেই নারীকে দাঁড় করানো হয় গিলোটিনে; বেশ্যা, পতিতা, নষ্টা নামে ডাকা হয় তাকে। এই সমাজে নারীর শরীরের মালিক নারী নিজে নয়। সে সেই শরীর কতোটা ঢাকবে, কতোটা খুলবে নিজের ইচ্ছেতে, তা নির্ধারণ করতে পারে না। পুরুষতন্ত্র তা ঠিক করে দেয়। পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্র তার শরীরকে ব্যবহার করে, কাজে লাগায়।

স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে চলবে। সবাই হচেতন হোক, এটাই আমাদের চাওয়া। কিন্তু যে বিশাল সংখ্যক নারী অসুখের কথাটি লুকিয়ে রাখেন সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য, সেই বিপুল সংখ্যক নারীর মনের ক্যান্সার দূর করবে কে?

যে নায়লা নাঈম স্তন ক্যান্সারের যৌনতাপূর্ণ প্রচারের বিষয়টিতে নিজের ব্যবহৃত হওয়ার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেন না, সেই নায়লাদের মনের বিষ সারিয়ে তুলবে কে? কবে নিজেকে ভালোবেসে নিজের শরীরের যত্ন নিতে শিখবে এদেশের মেয়েরা? কবে সে নিজের শরীরকে ‘নিজের শরীর’ বলে বিশ্বাস করতে শিখবে?

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৫:০০ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ

Share