চাঁদপুর

চাঁদপুরের সংবাদপত্র ব্যবসায় ৪৪ বছরের কিংবদন্তি সামছুল হক মোল্লা

আমার ধূসর স্মৃতির আয়নায় কিছুদিন পূর্বে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সংবাদপত্রসেবী সামছুল হক মোল্লার কথা। তাই ছুটে গেলাম চাঁদপুর পৌরসভার দর্জিঘাটলা সংলগ্ন তার স্থায়ী বাসায়। যাওয়ার পথেই দেখা হলো মোল্লার সাথে। তিনি ধীরে ধীরে লাঠি ভর করে আসরের নামাজ পড়তে মসজিদের দিকে আসছিলেন।

পরিচয় দেয়া মাত্রই তিনি চিনে ফেলে গনি ভাই বলে গলায় ঝাপটে ধরলেন আর বললেন, কেমন আছেন গনি ভাই! আমাকে বেশি ভালো জানার আরো একটি কারণ ছিলো সামছুল হক মোল্লার শ্বশুরবাড়ি ছিলো সফরমালী।

আর সেটা হলো আমার চাকুরিস্থল। যেথানে আমি বর্তমানে ২৯ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। চাঁদপুর কলেজে পড়ূয়া ছাত্র অবস্থায়ই আমার পত্রিকা পাঠ্যাভ্যাস গড়ে উঠে । তখন সময় পেলে সামছুল হক মোল্লার দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রকমের দৈনিক পত্রিকা পাঠের সুযোগ পেতাম।

সামছুল হক মোল্লা দীর্ঘ ৪৪ বছর চাঁদপুরের সে পুরান টাউন হলের নিচে সিঁড়ির পাশে বসে বসে সংবাদপত্র বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন চরম আকার ধারণ করে ঠিক তখনই তিনি প্রথম টাউন হলের নিচে ফলের ব্যবসা শুরু করেন ।

স্বাধীনতার পর পর তিনি টাউন হলের নিচে ফলের ব্যবসার পাশাপাশি সংবাদপত্র বিক্রি করা শুরু করেন। তখন সংবাদপত্রের এজেন্ট ছিলেন মরহুম আছলাম খান। সিঁড়ির নিচে তার দোকানটি ছিল। তৎকালীন সময়ে ‘পাকওয়াটার’ পরবর্তিতে ‘বেঙ্গল ওয়াটার’ নামক জলযান চাঁদপুর টু ঢাকাগামী নৌ-পথের এ জলযানটি চলাচল করে।

বেলা ১১ টায় চাঁদপুরের পেপার তখন বেঙ্গল ওয়াটারে চলে আসতে। মরহুম আছলাম খান মাঝে মধ্যে কোথাও গেলে সংবাদপত্রের জন্য মানুষ তাকে খোঁজাখুজি করতেন। বাধ্য হয়ে সামছুল হক মোল্লাকে সংবাদপত্র বিক্রির তিনি জন্য বলেন। সামছুল হক মোল্লা সেই থেকে সংবাদপত্র বিক্রির ব্যবসায় নিজেকে পরিচালিত করেন। আছলাম খান মৃত্যুবরণ করলে তার সহকর্মী শাহ আলম নামের অপর একজন সংবাদপত্র সেবী তার দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও এ ব্যবসা ছেড়ে দিলে নুরুন্নবী ওই ব্যবসা চালান। তখনও আমি পত্রিকা ছাড়িনি ।টাউন হল ভেঙ্গে দিলে আমি আমার ব্যবসা আস্তে আস্তে ছেড়ে দেই ।’

সামছুল হক মোল্লা ১৯৩৭ সালের বর্তমান চাঁদপুর পৌরসভার বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে বর্তমানে বিষ্ণুদী গ্রামে দর্জি বাড়ি এলাকায় জম্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সেকান্দর মোল্লা এবং মাতার নাম আছমতের নেছা। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছোট খাটো ব্যবসা নিয়ে জীবন যুদ্ধ শুরু করেন। বর্তমান বয়স ৮১ বছর । বর্তমানে জীবন সায়াহ্নে এসে কোনো মতে বাসা থেকে বের হয়ে দর্জি বাড়ির মসজিদে এসে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন।

ফলের ব্যবসার পাশাপাশি তিনি স্বাধীনতার পর পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। এক সময় ফলের ব্যবসা ছেড়ে শুধুমাত্র পত্রিকাই বিক্রি শুরু করেন। বয়সের ভাড়ে নুঁয়ে পড়া সামছুল হক মোল্লা এখন পলিত কেশ ৮১ বছরে বৃদ্ধ। সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সংবাদপত্র সেবীদের নিয়ে তার রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞা আছে ।

১৯৬৬ সালে সংবাদপত্র বা খবরের কাগজের প্রতি মানুষের প্রচন্ড ঝোঁক ছিল । চাঁদপুর জেলা সদরের এমন কোনো রাজনীতিবিদ,ডাক্তার,সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান, মেম্বার, রোটারীয়ান,সমাজ কর্মী,সমাজ সেবী লোক নেই সামছুল হক মোল্লা চেনে না। সবাই তার নাম জানতেন এবং মোল্লা বা মোল্লাজি বলে স¤োধন করে পত্রিকা কিনতেন।

এদের মধ্যে যাদের নাম ওই মূহুর্তে বলতে পারছেন তাঁরা হলেন , সর্বজনাব মরহুম আ.করিম পাটোয়ারী, অ্যাড.ইকবাল বিন বাশার,শেখ হাবিবুর রহমান,জীবন কানাই চক্রবর্তী, আবু নঈম দুলার পাটওয়ারী,মাসুদ ভূঁইয়া,শাহাজান চোকদার প্রমুখদের নাম মনে করতে পারছেন। ছোট বড় ধনী দরিদ্র পেশার মানুষ পত্রিকার প্রয়োজনে সামছুল হক মোল্লার নিকট আসতেন। কোনো কোনো ব্যক্তি ঢাকা হোটেল থেকে বেড়িয়েই মোল্লার দোকানে এসে পত্রিকা ক্রয় করেতেন এবং রিকশায় চড়ে চলে যেতেন। ১৯৮০ সাল থেকেই তার পত্রিকা ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠে ।

সাবেক রাষ্টপতি হুসাইন মোহাম্মদ এর আমলে প্রচুর পত্রিকার কাটতি ছিলো। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় প্রচুর পেপার চলতও। এগুলোর মধ্যে ছিলো ইত্তেফাক,ওভজারভার,সংবাদ,আজকের কাগজ, খবর ও দৈনিক বাংলা । সাপ্তাহিক পত্রিকার মধ্যে ছিল চিত্রালী,বেগম,রোববার,ইত্যাদি। এর মধ্যে মহিলাগণ বেগম পত্রিকাটি বেশি খোঁজ করতেন বলে তিনি জানান। চাঁদপুরের পত্রিকার মধ্যে ছিল চাঁদপুর কন্ঠ,রূপসী চাঁদপুর ও সংবাদ প্রভূতি।

প্রতিদিনই সামছুল হক মোল্লার সাথে আমার (প্রতিবেদক)দেখা হতো। রোববার (১৩ মে )আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত আবেগ কন্ঠে বলেন, ‘৮১ বছরের জীবনে আমি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। সবাই আমাকে চিনেন। তাই সকলের নিকট আজ আমি দোয়া প্রার্থী। পারত পক্ষে কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি ।’

৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক সামছুল হক মোল্লা। বড় ছেলে ও মেঝে ছেলে প্রবাসী। ছোট ছেলে কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে কোম্পানীর তাকে প্রয়োজনে বিদেশে পাঠিয়েছেন। জীবনের শেষ দিকে তার ভালোই দিন কাটছে বলে জানান। কিছুদিন পূর্বে তার এক মেয়ে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে তিনি অত্য›ত ভেঙ্গে পড়েন।

সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আপনাকে কে বাসতেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই আমাকে ভালোবাসতো। তবে বিশেষ করে প্রফেসর দেলোয়ার আহমেদ, গেলাম কিবরিয়া জীবন,শাহতলীর এম এম হেলাল উদ্দিন,ইকরাম চৌধুরী,কাজী শাহাদাত মুনির চেীধুরী, ইকবাল পাটওয়ারী,শহীদ পাটওয়ারী, আপনি (আবদুল গনি) সহ তিনি আরো বেশ ক’জনের নাম বলতে পারছেন ন্া।

চাঁদপুর শহরের অনেক নামি দামী লোক আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকার নাম বলা মাত্রই পত্রিকার চেহারা দেখে আমি দাঁড়িয়ে পত্রিকাটি হাতে তুলে দিতাম। কতো মানুষ যে আমাকে চিনতো শুধু পত্রিকার কারণে তা বলে শেষ করা যাবে না।’

তিনি বলতেন,‘সকালের ট্রেন টা আসা মাত্রই চাঁদপুর শহর মানুষ ভরে যেতো। পত্রিকাও বিক্রি হতো হরদম। এখন রাতে ঘুমানোর সময় অনেক লোকের চেহারা ভেসে উঠে। আমি বাসায় বাসায় পত্রিকা বিলি করেনি। আমি বসে বসে পত্রিকা বিক্রি করেছি। পত্রিকার ব্যবসা করেছি। আমি অশিক্ষিত হলেও শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী লোকজন আমার কাস্টমার ছিলো। পত্রিকার নাম বললেই চেহারা দেখে আমি চট করে ওই পত্রিকাটি বের করে দিতাম। ফলে প্রতিটি দিন ছিল আমার জন্য খুবই সৌভাগ্যের।’

সবশেষে তিনি আমাকে একটি কথা বললেন,‘ গনি ভাই! আমার মৃত্যু সংবাদটি আপনি একটু পত্রিকায় লিখবেন। কেননা চাঁদপুরের অনেক মানুষই আমাকে চিনতেন ও ভালোবাসতেন।’

সংবাদপত্রসেবী সামছুল হক মোল্লার দিন কাটছে ছেলের নিমাণকৃত সুন্দর ইটের ভবনে,শুয়ে বসে টিভি দেখে,নাত- নাতনিদের নিয়ে, নামাজ ও তসবি পাঠের মাধ্যমে তার এখন দিন কাটছে । আস্তে আস্তে হেঁটে মসজিদে আসতে পারেন বলে সামছুল হক মোল্লা জানান। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি সবারই দোয়া চেয়েছেন। আমরা সেই সংবাদপত্র সেবী সামছুল হক মোল্লর দীর্ঘূ ও সু-স্বাস্থ্য কামনা করছি ।

প্রতিবেদক : আবদুল গনি
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৬:১৮ পিএম,১৭ মে ২০১৮,বুধবার
এজি

Share