Home / বিশেষ সংবাদ / বাংলা সংগীতে কবি কাজী নজরুল
Nazrul--..

বাংলা সংগীতে কবি কাজী নজরুল

বাল্যকাল থেকেই কবি নজরুল সংগীত রচনা করেন। সংগীত রচনার হাতে খড়ি বাল্যকাল থেকেই থেকেই তিনি পারদর্শিতা পরিচয় দেন । ১৯২০ সালে কবি নজরুলের আনুষ্ঠানিক সংগীত রচনা শুরু হয়। করাচি থেকে ফিরে এসেই তিনি কবিতা ও গানে মনোনিবেশ করেন। ১৯২০ সাল থেকেই ১৯৪২ সালে এ পর্যন্ত এ বছরের বেশিরভাগ সময় কাটে গান আর কবিতা লিখে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ২৮০০ গান রচনা করেছেন এবং এর মধ্যে কুমিল্লা দৌলতপুওে ১২০টি গান ও ১৬০ কবিতা রচনা করেন ।

গানগুলো ২৩ প্রকার : এগুলো হলো নজরুলগীতি,জাগরণী,দেশাত্মবোধক, গজল,ভক্তিমূলক হাম-নাত, ভজন, কীর্তন,শ্যামা সংগীত,বাউল,কাব্যগীতি,ঋতু সংগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ধ্রুপদ,খেয়াল,হাসির গান ও শেখর । শুধু তাই নয় তিনি সংগীত শিক্ষকও ছিলেন। তৎকালীন সময়ের বিশেষজ্ঞ সাহেবের কাছ থেকে ঢাকায় এসে তিনি নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ও তৈরি করেন কবি নজরুলের গান

আসে বসন্ত ফুলবনে :এ গানটি দিন ১৩৩৩ সালের ২৮ অগ্রহায়ণে রচনা করেন । যা সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে চোখের এর অন্তর্ভুক্ত হয়। গানটি রেকর্ড করেছিলেন গানের পাখি নামে খ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন।

স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা :এ গানটি ১৩৪০ সালের জৈষ্ঠ্য মাসে রচনা করেন। মাসিক বুলবুলিতে প্রকাশ পায় এ গানটি। গানের মালা গ্রন্থে প্রকাশিত হয় ও শিল্পী আব্বাস উদ্দিন রেকর্ড করেন।

কারার ঐ লৌহ কপাট গান : ১৯২০ সালে রচনা করেন । ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে তখন হুগলি কলকাতা ও আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার কথা পত্রিকায় একটি চিঠি পাঠালে কবি এ অপূর্ব সুরে গানটি রচনা করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি মুজিব নগর বেতার থেকে প্রতিদিনই প্রচার হত। ফলে আমাদের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা পেয়েছ্ ে।

যার হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই : এ গানটি ১৯৩৮ সালে রচনা করেন । সন্তোষ সেনগুপ্ত এবং বুলবুল দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়। সম্ভবত নজরুলের দাম্পত্য জীবন সংঘটিত না হওয়া নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ের আগে নজরুলকে একটি চিঠি দিলে সেটি হাতে পাওয়ার সময় বন্ধু শৈলাজানন্দকে চিঠিটি খুলে পড়তে বলেন। তিনি চিঠিটি পড়ে বলেন এবং তার উত্তর দিতে বললেন। উত্তর দিলেন এ গানের মাধ্যমে।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আছে শান্ত হয়ে : এ গানটি ১৯৩০ সালের ৭ মে দ্বিতীয় পত্র অরিন্দম বুলবুল চার বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । এতে কাবর হৃদয়ে ভীষণ ব্যাথা পান। এ গানটি ১৩৪৪ সালে বুলবুল পত্রিকায় প্রকাশিত এ গানটি

নদীর নাম সই অঞ্জনা : হঠাৎ একদিন নজরুলের সামনে শিল্পী আব্বাস উদ্দিন নদীর নাম সই কচুয়া, ভাওয়াইয়া গানটি গান। নজরুল তাকে আবার গানটি গাইতে বললেন। এভাবে নদীর নাম সই অঞ্জনা গানটি রচনা করেন যা স্থান পায় এবং আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে রেকর্ড করা হয়্।

চল চল চল : গানটি কবি নজরুল ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে রচনা করেন। গানটির গীতিকার কে ১৩৩৪-১৩৩৫ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে এ গানটি রচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ও বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে এ গানটি আমাদের সেনাবাহিনীর মার্চিং সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো জন্যেই তিনি ্এ উদ্যোগ নেন।

মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী : এটি একটি জনপ্রিয় গান। বঙ্গবাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নজরুলগীতি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত গানটি রচনা করেন।

শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল : হুগলী জেলে ১ বছরের কারাদণ্ড খোগকরার সময়ে তিনি এ গানটি লিখেন ্। ১৩৩১ সালের সকল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ গানটি রচনা করেন জেলে বসে।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে :এ ভক্তিমূলক গানটি শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের বিশেষ অনুরোধে তিনি এ গানটি রচনা করেন। এটি নজরুলের গান হিসেবে বর্তমানে পরিচিত্। জুলফিকার গ্রন্থে এ গানটি স্থান পেয়েছে। কবি তার প্রিয় শিক্ষার্থী ইন্দুবালা গান শেখাতে ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই শিল্পী আব্বাস উদ্দিন একটি ইসলামিক সংগীত লেখার প্রস্তাব দেন। কবি ইন্দুবালকে বাড়ি যেতে বলার পর অর্থ ঘণ্টার মধ্যে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঐতিহাসিক ইসলামিক এ সংগীতটি রমজান শেষে ঈদেও আগমনী বার্তা বহনকারী এ গানটি রচনা করেন।

আমরা শক্তি আমরা বল:গানটি ১৯২৬ সালে কবি রচনা করেন । ১৯২৬ সালের বার্ষিক সম্মেলনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তিনি এ গানটি রচনা করেন।

ইসলামের সওদালয় : এ গানটি কবি ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে গানটি রচনা করার পরের দিনই এটি রচনা করেন। এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতীতে ১৩৩৮ সালে এটি প্রকাশিত হয় আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে এটি পরবর্তী সময়ে রেকর্ড করা হয়।

জাগো অনশন বন্দী : ফরাসি ভাষায় অনূদিত ছিল পরে তিনি তরজমা করে বাংলায় আনেন রচনাকালে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে পহেলা বৈশাখ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে গণবাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়

জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা : ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে নামে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয় আনন্দমঠ এর উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে তিনি নিজেই এ গানটি পরিবেশন করেন। বাংলা ভাষার জগতে আগমন করে নিয়েছেন থাকবে ।

সংগীত
কাজী নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর কবি
কবি কাজী নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। সারাজীবন তিনি অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। আর এ খ্যাতির পিছনে রয়েছে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও সৃষ্টিশীল সাত্যি কর্ম। একজন কবি এতগুলো কবিতা, গল্প, নাটক,গ্রন্থ, গজল, ইসলামী গান ও সংবাদপত্র সম্পাদনা করেন তা সত্যিই বিস্ময়কর প্রতিধর এ কবিকে আমরা একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার,শিশু সাহিত্যিক, ছোট গল্পকার,লেখক, অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, সম্পাদক, হামদ নাত লেখক, বাংলাবাদক,‘লাঙ্গল’ পত্রিকায় তিনি সাম্যবাদী, বিপ্লবী কবিতা প্রকাশ পায় এবং এখানে তিনি বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ইংরেজদের রোষানল এড়ানোর জন্যে।খোলা মনের প্রেমিক হিসেবে চিনত।

ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন ছদ্ম নামত ব্যবহার করেন। এ গুলো হলো- কহলন, সারমি, শ্যামসুন্দর, বুলবুল, পাইয়োনিয়ার ও ধূমকেতু। প্রতি বছর তাঁর রচিত রমজানের ঈদের যে সঙ্গীতটি বাজানো হয়Ñ তা মুসলিম জাহানের প্রত্যেক নর-নারীকে উদ্বেলিত করে থাকে। অগ্নিবীণার বিদ্রোহীর সুর উদ্ভাসিত হয়েছে। বিদ্রোহী কবিতা থেকেই তিনি বিদ্রোহী কবি খ্যাতি অর্জন করেন। এটি একটি অনবদ্ধ সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্ম- যা এক রাতে তিনি লিখেছেন। নজরুলের রনসঙ্গীত এখন স্বাধীন সার্বভৌমিক রাষ্ট্রে বা রণসঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৩২ সালে কবি তাঁর বিখ্যাত কান্ডারীর হুশিয়ার, গান গেয়ে শোন করে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০ বছর। সে সময় তাঁকে বাঙালি জাতির পক্ষে থেকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।

নজরুলের অজস্র সুন্দর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বা কবিতাগুলো উদ্দীপনমূলক কবিতা, দেশকে ও দেশের মানুষকে, কৃষক, কুলি,মজুর , জেলে সবাইকে ভালোবাসার কবিতা, স্বাধীনতার জন্যে কবিতা, বড় হওয়ার রোমাঞ্চকর স্বপ্ন, অভিযানের কবিতা নানা ধর্মের মানুষের জন্য প্রীতি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কবিতা, ধর্ম ও ঐতিহ্য বিষয়ক কবিতা তিনি লিখেছেন।

সমগ্র জীবনে বাংলা সাহিত্যের একজন কবি তিনি। সজনীকান্ড দাস নামক জনৈক ব্যাক্তি ছাড়া কেউ নজরুলকে কটাক্ষ করেছেনÑ এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তিনি ছিলেন মানবতার কবি,সাম্যের কবি, তারুণ্যের ও উদ্দীপনার কবি। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ও সৈনিক হিসেবে দৈহিকভাবে সুঠাম ও দক্ষ ছিলেন। তাঁকে কেউ ডাকতেন কাজী দা,কবিদা কেউ নুরু, কেউ নজরুল। তিনিই নজরুল ইসলাম। আমাদের হৃদয়ের কবি সাহিত্যের কবি। জাতীয় কবি ও সর্বোপরি তিনি ছিলেন বিদ্রোহী কবি। এত প্রতিভা সম্পন্ন বাংলা সাহিত্যের আর দ্বিতীয় কেউ আছে কি-না তা জানা হয়নি আজও।

তথ্যসূত্র : মো.হাবিবুর রহমান রচিত‘ছোটদের নজরুল, নবারুণ, বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক পত্রিকা ,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায়‘ কাজী নজরুলের জীবনী’, বেদার উদ্দিন আহমেদ রচিত নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি

লেখক:আবদুল গনি,শিক্ষক প্রাবন্ধিক,সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল গবেষণা পরিষদ,চাঁদপুর।
২৮ জানুয়ারি ২০২২