দেশের জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এক লাফেই ডলারের দাম বেড়েছে ৭ টাকা। ফলে কয়লা, গ্যাস, জ্বালানি তেলের মতো পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়বে। এতে দেশে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিলের বড় অংশই পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এ খাতেও খরচ বাড়বে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকার এই অবমূল্যায়ন ডলার ও নগদ অর্থ সংকটে ভোগা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আরও চাপে ফেলবে। শুধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বকেয়া পরিশোধেই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে।
সরবরাহ পর্যায়ে খরচ বাড়লে সরকারের ভর্তুকিও বাড়বে। অন্যদিকে সরকার যেহেতু ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে; ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আরও বাড়াবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে।
ডলার সংকটে জ্বালানি আমদানি প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হয়। দাম বাড়ায় এই সংকট আরও ঘনিভূত হবে। এমনটি হলে চলমান গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতে ঘাটতি বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে লোডশেডিং।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ডলারের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণপ্রাপ্তির শর্ত মেনে গত বুধবার ডলারের নতুন দর নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা হয়ে যায়। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৫ টাকার কম নয়।
বকেয়া পরিশোধে ব্যয় বাড়বে
জানুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে বিল বকেয়া রয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ (স্থানীয় খরচ বাদে) এবং জ্বালানির দাম ডলারে পরিশোধ করতে হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিলও দিতে হয় ডলারে। মার্কিন মুদ্রার দাম বৃদ্ধিতে এই বকেয়া পরিশোধেই পিডিবির অতিরিক্ত খরচ হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ৷
শেভরনের পাওনা এবং এলএনজি আমদানি
বাবদ পেট্রোবাংলার বকেয়া প্রায় ৪০ কোটি ডলার। টাকার অবমূল্যায়নে এই বকেয়া পরিশোধে দেশীয় মুদ্রায় সংস্থাটির বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
ডলার সংকটে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেল কেনা বাবদ বকেয়া জমেছে প্রায় ৩২ কোটি ডলার। এর মধ্যে আইটিএফসির ঋণ ২ কোটি টাকা। বাকিটা বিদেশি তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর পাওনা। ডলারের মূল্য বাড়ায় এই বকেয়া শোধ করতে বিপিসির অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকা খরচ হবে।
দাম বাড়বে বিদ্যুৎ-জ্বালানির
দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ১০৩ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা। ১২৩ কোটি ঘনফুট পাওয়া যায় দেশের অভ্যন্তরে কাজ করা শেভরনসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। এই ২২৬ কোটি ঘনফুট গ্যাসের দাম ডলারে পরিশোধ করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে এ খাতে খরচ বাড়বে। আইএমএফের পরামর্শে গ্যাসের দাম কয়েক দফা বাড়িয়ে ভর্তুকি থেকে প্রায় বেরিয়ে এসেছে সরকার। ডলারের কারণে খরচ বৃদ্ধি পেলে আবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে হবে।
শুধু ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয় ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। সে সময় ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল ৯৯ টাকা ৪৫ পয়সা।
বাড়তি খরচ মেটাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। কারণ, আইএমএফের শর্ত মেনে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসছে সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতে খুচরা দাম সাড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। চলতি মাসেই আরেক দফা দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসের শুরুতে বেসরকারি পর্যায়ের এলপি গ্যাসের খুচরা দাম নির্ধারণ করে। এলিপিজির কাঁচামাল বিউটেন ও প্রোপেন পুরোটাই আমদানি করতে হয়। দাম নির্ধারণে ডলারে বিনিময় হার বিবেচনায় নেয় বিইআরসি। ফলে আগামীতে রান্নার জন্য জনপ্রিয় সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়বে।
ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোলের দাম বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়। এর প্রায় পুরোটুকুই আমদানি করা হয়। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডলারের দাম বাড়ায় লিটারে তেলের দাম ৬-৭ টাকা বাড়বে।
ভর্তুকি বাড়বে
চলতি বছর বিদ্যুতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। তবে দুই দফায় দাম বাড়ানোর ফলে ভর্তুকি প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
অর্থ বিভাগের হিসাবে, ডলারের দাম এক টাকা বাড়লে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাড়ে প্রায় ৪৭৪ কোটি টাকা। ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ায় ভর্তুকি বাড়বে প্রায় ৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তা ইমরান করিম বলেন, ডলার সংকট ও বকেয়ার কারণে ঠিকমতো এলসি খোলা যাচ্ছে না। এখন আবার দাম বাড়ল। ফলে আগের এলসিগুলোতেই ৪০০-৫০০ কোটি টাকা লোকসান হবে। (সমকাল)