বিশেষ সংবাদ

শ্রমিক দিবসের ইতিহাস

১মে দিনটি পৃথিবীর অনেক দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয় যা মে দিবস নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই এ দিনটি সরকারিভাবে ছুটির দিন। ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও আত্মাহুতিকে এদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরন করা হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশে পালিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এ দিনটি পালিত হয় না।

‘শ্রমিক’-সভ্যতার প্রতিটি ইট,বালু, পাথরে যাদের ফোটা ফোটা ঘাম জড়িয়ে আছে তারা কিন্তু কখনোই সভ্যতার আশীর্বাদধন্য শ্রেণি ছিলনা, এখনো নয়। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিককার কথা। শ্রমিকরা তখনো শোষিত, সপ্তাহে ৬ দিনের প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টার অমানবিক পরিশ্রম করতো কিন্তু তার বিপরীতে মিলত নগন্য মজুরী। অনিরাপদ পরিবেশে রোগ-ব্যধি, আঘাত, ম্রত্যুই ছিল তাদের নির্মম সাথী। তাদের পক্ষ হয়ে বলার মত কেউ ছিলনা ।

১৮৬০ সালে শ্রমিকরাই মজুরি না কেটে দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম নির্ধারণের প্রথম দাবি জানায়। কিন্তু কোন শ্রমিক সংগঠন ছিলনা বলে এ দাবি জোরালো করা সম্ভব হয়নি। এ সময় সমাজতন্ত্র শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। শ্রমিকরা বুঝতে পারে বণিক ও মালিক শ্রেণির এ রক্ত শোষণ নীতির বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত হত হবে।

১৮৮০-৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organized Trades and Labor Unions of the United States and Canada .১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় American Federation of Labor. এ সংঘের মাধ্যমে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে।

১৮৮৪ সালে সংঘটি ‘৮ ঘন্টা দৈনিক মজুরি’ নির্ধারনের প্রস্তাব পাশ করে এবং মালিকও বনিক শ্রেণিকে এ প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। তারা এ সময়ের মধ্যে সংঘের আওতাধীন সকল শ্রমিক সংগঠনকে ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংগঠিত হওয়ার পুনঃ পুনঃ আহবান জানায়।

প্রথম দিকে অনেকেই একে অবাস্তব অভিলাষ, অতি সংস্কারের উচ্চাকাংখা বলে আশংকা প্রকাশ করে। কিন্তু বণিক-মালিক শ্রেণির কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদি ও প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে থাকে। এ সময় এলার্ম নামক একটি পত্রিকার কলাম ‘একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘন্টাই করুক,সে দাসই’ যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালে। শ্রমিক সংগঠনদের সাথে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রপন্থী দলও একাত্মতা জানায়। ১ মে কে ঘিরে প্রতিবাদ,প্রতিরোধের আয়োজন চলতে থাকে। আর শিকাগো হয়ে উঠে এ প্রতিবাদ প্রতিরোধের কেন্দ্রস্থল।

১ মে এগিয়ে আসতে লাগল। মালিক-বণিক শ্রেণি অবধারিতভাবে ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। ১৮৭৭ সালে শ্রমিকরা একবার রেলপথ অবরোধ করলে পুলিশ ও ইয়ুনাইটেড স্টেটস আর্মি তাদের উপর বর্বর আক্রমন চালায়। ঠিক একইভাবে ১ মে কে মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রস্তুতি চলতে থাকে।

পুলিশ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র সংগ্রহে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। ধর্মঘট আহবানকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য শিকাগো বাণিজ্যিক ক্লাব ইলিনয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ২ হাজার ডলারের মেশিন গান কিনে দেয়।

১ মে সমগ্র যুক্ত্ররাষ্ট্রে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে এদিন রাস্তায় নেমে আসে। শিকাগোতে শ্রমিক ধর্মঘট আহবান করা হয়, প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। অগ্নি গর্ভ বক্তৃতা, মিছিলে, মিটিং, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি সবকিছুই মিলে ১ মে উত্তাল হয়ে উঠে।

পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পীজ, লুই লিং সহ আরো অনেকেই শ্রমিকদের মাঝে পথিকৃত হয়ে উঠেন। ধীরে ধীর আরো শ্রমিক কাজ ফেলে আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনকারি শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১লাখ । আন্দোলন চলতে থাকে। ৩ মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন।

আগস্ট স্পীজ জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাত দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরন ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয় এবং ১১ জন আহত হয়,পরে আরো ৬ জন মারা যায়। পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা সাথে সাথেই রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়।

এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুই লিং একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্যএকজনের ১৫ বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এ নি:শব্দতা,তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”।

২৬ জুন ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত ৮ জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত ওই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি।

শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার” দাবি অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। আর পহেলা মে বা মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। পৃথিবীব্যাপি আজও তা’পালিত হয়।

নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭ : ৫৫ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার
এজি

Share