সিলেট শহরতলির বাদেআলী গ্রামের ১৩ বছরের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন। কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাই লেখাপড়া ছেড়ে মায়ের সাথে সবজি চাষ এবং তা বাজারে বিক্রি করেই নিত্য অভাবের সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতো রাজন।
এই নিরীহ গরিব সবজি বিক্রেতা শিশুটিই জাগিয়ে তুললো পুরো দেশ। জাগিয়ে তুললো পুরো দেশের বিবেক। পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এলো এই শিশুর জন্য। লাখো মানুষ দাবি জানালো ন্যায় বিচারের এবং দ্রুত বিচারের। এমনকি জনতা উদ্যোগী হয়েই আসামিদের তুলে দিলো পুলিশের হাতে।
হত্যাকাণ্ডের ঠিক চারমাসের মধ্যে দ্রুত সময়ের রায় ঘোষণা হলো। এ বিচার দ্রুত হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু সিলেট নয়, সারা দেশেও বিরল। জানা মতে, এমন নজিরবিহীন আর এত দ্রুতার সঙ্গে কোনো মামলার কার্যক্রম শেষ হয়নি।
অবশ্য শিশু রাকিব হত্যা মামলার রায়ও একইদিনে (রোববার) ঘোষিত হয়েছে খুলনায়। তবে জাগরণটা শুরু করে গিয়েছিল শিশু রাজনই।
রাজন হত্যার রায়ে ৪ জনকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩৪ ধারায় সবোচ্চ শাস্তি ফাঁসি, পেনাল কোর্ডের ১০৯, ৩০২ ও ৩৪ ধারায় একজনকে যাবজ্জীবন, লাশ গুম করার অপরাধে ২০১ ধারায় তিন সহোদরকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, দুইজনকে এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও তিনজকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৮ জুলাই। এই সকালেও অন্যান্যদিনের মতো সবজি বিক্রি করতে কুমারগাও যায় রাজন। কুমারগাওয়ে একটি গাড়ি মেরামতখানায় চুরির অপবাদে রাজনকে আটকে রেখে মারধর শুরু করে ওই মেরামতখানার চৌকিদার ময়না। (যদিও আদালতে সাক্ষীরা জানিয়েছেন, বলাৎকারে ব্যর্থ হয়েই রাজনের বিরুদ্ধে চুরির অপবাদ তুলে ময়না।)
এরপর সেই মারধরে এসে শরিক হয় এই গাড়ি মেরামতখানার মালিক মুহিত হোসেন, তার ভাই সৌদি আরব প্রবাসী কামরুল ইসলামসহ অন্য ভাই ও আশপাশের আরো কয়েকজন। বিকৃত-বীভৎস নির্যাতন চালানো হয় রাজনের উপর। এই নির্যাতনের ভিডিওচিত্রও ধারণ করে ঘাতকরা।
নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের একপর্যায়ে মারা যায় শিশু রাজন। মৃত্যুর আগে পানি খেতে চেয়েছিলো রাজন। তাকে ঘাম খেতে বলে ঘাতকরা। রাজন মারা যাওয়ার পর মাইক্রোবাসযোগে লাশ গুম করতে নিয়ে যায় মুহিত।
কুমারগাও এলাকাবাসীর এতে সন্দেহ হলে তারা মাইক্রোবাসটি আটক করে দেখতে পান ভেতরে একটি মরদেহ। সাথে সাথে তারা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে ও মুহিত আলমকে আটক করে নিয়ে যায়।
ওই রাতেই জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে ‘চুরির দায়ে গণপিটুনিতে অজ্ঞাতনামা এ ব্যক্তির মৃত্যু’র ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। রাতে ছেলের লাশ সনাক্ত করে থানায় মামলা করতে আসেন রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান। তার সাথে দুর্ব্যবহার করে থানা পুলিশ। তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ তখন ঘাতকদের সাথে আপোস রফায় ব্যস্ত ছিল।
পরদিন বাদেআলী গ্রামের লোকজন জালালাবাদ থানা ঘেরাও করে। সেদিন রাজনের বাবাকেও দেওয়া হয় আপোস প্রস্তাব। এইদিনই পুলিশের সাথে দফারফা করে সৌদি আরব পালিয়ে যায় প্রধান অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম।
তবে তখন পর্যন্ত পুলিশ, ঘাতকেরা, রাজনের গ্রামের লোকজন আর সংশ্লিষ্ট দু’একজন ছাড়া তেমন কেউ জানতেন না ঘটনাটি। মিডিয়ায় গুরুত্বহীনভাবে এসেছে লাশ উদ্ধার আর মামলা দায়েরের খবর।
১০ জুলাই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে রাজনকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র। ১১ জুলাই থেকে সকল মিডিয়ার প্রধান খবরে পরিণত হয় এই ভিডিওচিত্র। এরপর তো ইতিহাস।
দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। টনক নড়ে প্রশাসনের। সরকারের বড় বড় মন্ত্রীরা গিয়ে ভিড় করতে থাকেন রাজনের বাড়িতে। আসে বিভিন্ন মহল থেকে অর্থ সাহায্য। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলতে থাকে দেশের বাইরেও।
দেশজুড়ে সৃষ্ট আলোড়নের ফলে যে রাজনের বাবাকে দুই-তিন দিন আগেই থানা থেকে গালি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাকেই দেওয়া হয় সার্বক্ষণিক পুলিশি নিরাপত্তা। মামলার বাদীসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়।
একে একে ধরা পড়তে থাকে রাজন হত্যার আসামিরা। জনতা পুলিশের হাতে তুলে দিতে থাকে আসামিদের। স্থানীয় এলাকাবাসী ১০ জন আসামিকে আটক করে পুলিশে দেন। এমনকি ১২ জুলাই সৌদি প্রবাসী বাঙালিরা কামরুল ইসলামকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বিচার কাজও চলতে থাকে দ্রুত।
অবশেষে হত্যার মাত্র ৪ মাসের মধ্যে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মামলার রায় ঘোষিত হলো। সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা আলোচিত এই মামলাটির রায় ঘোষণা করেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে এই হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১০ দিনে মামলায় ৩৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পরবর্তী প্রধান আসামি কামরুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে আরো ১ দিনে ১১ জন সাক্ষীর পুনরায় স্বাক্ষ্যগ্রহণ হয়। পরে টানা তিন কার্যদিবসের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয় ২৭ অক্টোবর।
উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা ৮ নভেম্বর মামলাটির চূড়ান্ত রায় প্রদানের তারিখ ঘোষণা করেন। হত্যার চার মাস এবং চার্জ গঠনের ৩৬ দিনের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর এই মামলাল বিচার কাজ শেষ হয়ে রায় পাওয়া গেল।
গত ১৫ অক্টোবর কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার। মামলার ১৩ আসামির মধ্যে কামরুলসহ ১১ জন কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন শামীম ও পাভেল নামের দু’জন।
১৬ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২৪ আগস্ট আসামিদের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। ২৫ আগস্ট মালামাল ক্রোক করে পুলিশ। ৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তরের আদেশ হয়।
নিউজ ডেস্ক ||আপডেট: ১০:০৮ পিএম, ০৮ নভেম্বর ২০১৫, রোববার
এমআরআর