জাতীয়

শীতে করোনার প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা

করোনাভাইরাসের ওপর পরিবেশের বা তাপমাত্রার সরাসরি তেমন কোনো প্রভাব নেই। তবে আসছে শীতকালে দেশে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে- এমন মন্তব্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের।

তাদের মতে, শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাইরাসটির বাতাসে ভেসে বেড়নোর ক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি শীতকালে এদেশের মানুষের একসঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে বসার প্রবণতা এই সংক্রমণ আরও ত্বরান্বিত করবে। এটি হতে পারে দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ওয়েভ।

এদিকে করোনাভাইরাস বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। গবেষকদের মতে, এসব পরিবর্তন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য দায়ী।

২৮ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আসছে শীতে দেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ আসবে কি না, এলে করণীয় কী- এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভ বা ঢেউয়ের জন্য এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে।

এক্ষেত্রে কন্টাক ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি পরামর্শক কমিটি সর্বস্তরে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মানতে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেন।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, আমাদের দেশে এখনও করোনার প্রথম ধাক্কা চলমান। কোনোভাবেই আমার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও এখনও বিপৎসীমাতেই রয়েছে। এর মধ্যে যদি সংক্রমণের গতি আরও বাড়ে এবং রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাস যদি আরও শিক্তশালী হয়ে আক্রমণ শুরু করে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই জীবনযাপন পদ্ধতিতে স্বাভাবিকতা এলেও কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, তাপমাত্রার সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও শীতে এর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কারণ শুষ্ক আবহাওয়ায় এই ভাইরাস বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকে, তাই সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। দ্বিতীয়ত, শীত এবং বর্ষায় মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়, গাদাগাদি করে থাকে, সামাজিক দূরত্ব কম পালন করা হয়, ফলে সংক্রমণ বেড়ে যায়।

তৃতীয়ত, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় অ্যাজমা, সিওপিডিসহ ফুসফুসের রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়। করোনাভাইরাসের মূল টার্গেটই যেহেতু ফুসফুস, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে অল্প পরিমাণ ভাইরাস প্রবেশ করেই বেশি ক্ষতি করতে পারে। সোজা কথা, সতর্ক না হলে কয়েক মাস পর আবার লাফ দিয়ে শনাক্ত এবং মৃত্যু বেড়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমদের দেশে প্রথম ওয়েভ এখনও চলমান। তাই শীতে দ্বিতীয় ওয়েভ বা ঢেউ আসবে, সেটা বলা যায় না। এখনও সংক্রমণের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। যে কোনো রোগের সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ বা এর নিচে না নামলে সেটাকে কখনোই নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি বলা যাবে না।

শীতে প্রকোপ বাড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুষ্ক আবহাওয়া এবং আবদ্ধস্থানে জড়োসড়ো হয়ে থাকার যে চিরায়ত অভ্যাস আমাদের দেশের মানুষের রয়েছে, সেটি চলমান সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তিনি এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

এদিকে করোনাভাইরাস দেশে দ্রুত রূপ পরিবর্তন করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির এক দল গবেষক।

তারা জানান, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসটি বাংলাদেশে অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। যেখানে বিশ্বে করোনাভাইরাসের রূপান্তরের হার ৭ দশমিক ২৩ ভাগ, সেখানে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস রূপান্তরের হার ১২ দশমিক ৬০ ভাগ।

ভাইরাসবিষয়ক এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তারা বলেন, করোনাভাইরাসে মোট ২৮টি প্রোটিন থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্পাইক প্রোটিন, যার মাধ্যমে বাহককে আক্রমিত করে। স্পাইক প্রোটিনে ৬১৪তম অবস্থানে অ্যাসপার্টিক এসিডের পরিবর্তন হয়ে গ্লাইসিন হয়েছে।

এতে ‘জি৬১৪’ নম্বর ভ্যারিয়েন্টটি শতভাগ ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই আধিপত্যের কারণে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে।

তারা জানান, দেশে এ পর্যন্ত ৩২৫টি করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জীবন নকশা বের করা হয়েছে। এর মধ্যে জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষকরা বের করেছেন ২৬৩টি।

এই ২৬৩টি ভাইরাসের জিন গবেষণায় তারা দেখেছেন, দেশের করোনা ভাইরাসগুলোর জিনোমিক পর্যায়ে ৭৩৭টি পয়েন্টে রূপান্তর (মিউটেশন) হয়েছে। এর মধ্যে অ্যামিনো এসিড পর্যায়ে ৩৫৮ নন-সিনোনিমাস অ্যামিনো এসিডে প্রতিস্থাপন ঘটেছে। এছাড়া স্পাইক প্রোটিনের জিনে ১০৩টি নিওক্লিটাইড রূপান্তরের (মিউটেশন) মধ্যে ৫৩টি নন-সিনোনিমাস অ্যামিনো এসিডে প্রতিস্থাপন ঘটেছে। এর মধ্যে ৫টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায়নি।

গবেষকরা বলছেন, সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে ৬ ধরনের করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ২৬৩টি করোনাভাইরাস পর্যবেক্ষণ করে বিসিএসআইআরের গবেষকরা ৪ ধরনের ২৪৩টি জিআর ক্লেড, ১৬টি জিএইচ ক্লেড, ৩টি জি ক্লেড এবং ১টি ওক্লেড করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পেয়েছেন। এছাড়া করোনার নমুনাগুলোর শতভাগ ক্ষেত্রে মোট ৪টি মিউটেশনে পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা গেছে। এসব পরিবর্তন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য মূলত দায়ী।

বাংলাদেশ থেকে ৩২৫টি করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য বের করা হয়েছে। এগুলো জিনোম সিকোয়েন্সের উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটা (জিসএআইডি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনলিক্যাল ইনফরমেশনে (এনসিবিআই) ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এসএম আলমগীর বলেন, তাপমাত্রার ওপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নির্ভরশীল নয়। তবে শীতে সংক্রমণ বাড়বে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

বিসিএসআইআরের গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গবেষণা ভাইরাসটির পরিবর্তনের যে হার সেটি অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা না করে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। (যুগান্তর)

বার্তা কক্ষ,৯ সেপেটম্বর ২০২০

Share