স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২৪ জানুয়ারি । ২০১৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালিত হয়। ইউনেস্কো এ বছর ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘স্থায়ী শান্তির জন্য শিক্ষা’। এ থিমটি শান্তির জন্য শিক্ষার গুরুত্বকে তুলে ধরে এবং সমসাময়িক বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্ক নির্দেশ করে। ইউনেস্কো বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হেট স্পিচের যে ছড়াছড়ি তা মোকাবেলায় শিক্ষা ও শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই এবারের দিবসটিকে এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উৎসর্গ করা হয়েছে।

আমাদের সহজ, সুন্দর, গতিময় ও নান্দনিক জীবনের মূলে রয়েছে শিক্ষা। আদিম সমাজ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গ্রিক নগররাষ্ট্র ও আজকের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এসেছে তার কারিগর শিক্ষিত জাতিগোষ্ঠী। সভ্যতার শুরুতে পুঁথিগত শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর রূপান্তরই বদলে দিয়েছে পৃথিবী। শিক্ষার উন্নতির ধারাবাহিকতায় নির্মিত হয়েছে আজকের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থা। এ বিষয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষা সব থেকে শক্তিশালী অস্ত্র, যার মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে দেয়া যায়।’ সত্যিই তাই। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে পৃথিবীর আর্থসামাজিক, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা-বিজ্ঞানসহ সব ক্ষেত্র।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সমাজ, অর্থনীতি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বিশেষ করে কৃষি খাতে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে তা শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তরেরই ফসল। ১৯৭১ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এখন দেশে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও এখনো দেশের ২৩ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। এ জনগোষ্ঠী সাত বছরের বেশি বয়সী। বিবিএসের প্রায়োগিক সাক্ষরতা জরিপ ২০২৩-এর তথ্য বলছে, ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রায়োগিক সাক্ষরতা প্রায় ৭৩ শতাংশ। আর ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এ হার ৭৩ দশমিক ৬৯। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জনের অন্যতম শর্ত দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা। এখনো দেশের শতকরা ২৩ দশমিক ২ ভাগ মানুষ নিরক্ষর। ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে। বর্তমানে দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি, এনজিও, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন ও অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার। শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন প্রায় সাড়ে ছয় লাখের বেশি শিক্ষক। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বিদ্যালয়ে পড়াশোনার উপযোগী ৬-১০ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৩১ হাজার শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে অর্থাৎ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা উপযোগী অধিকাংশ শিশুই শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও কমেছে। দশ বছরের ব্যবধানে ৩৯ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমে ঝরে পড়ার হার এখন ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়েও বেশি। উচ্চ মাধ্যমিকের ৫৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই নারী। পেশাগত শিক্ষায়ও ৬১ দশমিক ৪৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ছিলে ১২ হাজার, বর্তমানে এ স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২১ হাজার। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে ১ কোটি ১৩ লাখ শিক্ষার্থী। যার অর্ধেকের বেশিই মেয়ে শিক্ষার্থী। গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোয় পড়ালেখা করছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশি।

ইউনিসেফ ও দ্য এডুকেশন কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণকারীদের মধ্যে দক্ষতাহীন ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৩০ শতাংশ কিন্তু তিন দশকের ব্যবধানে ২০২৩ সালে গড় পাসের হার ছিলে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। শিক্ষার এ স্তরের অর্জনও আশাব্যঞ্জক।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পর নিতে হয় উচ্চ শিক্ষার পাঠ। উচ্চ শিক্ষা খাতেও সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। দেশের উচ্চ শিক্ষা খাতে দ্রুতই বিকশিত হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। গুণগত শিক্ষা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের কাছে। ১৯৯২ সালে সংসদে আইন পাস করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া শুরু করে সরকার। আইন পাসের পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ) ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)—এই দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষা শুরু হয়। তবে তিন দশকের ব্যবধানে দেশে এখন বেসরকারি খাতে অনুমোদিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০৯টি, যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুণ।

ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪৫ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। অন্যদিকে একই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭ শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্বীকৃতি অর্জন করেছে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও। অনেক ক্ষেত্রে র‍্যাংকিংয়ে পাবলিকের চেয়েও এগিয়ে থাকছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডসের (কিউএস) ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং এশিয়া ২০২৪’-এ দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে বাংলাদেশ থেকে স্থান পাওয়া প্রথম চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দুটিই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

দক্ষিণ এশিয়া র‍্যাংকিংয়ের এ তালিকায় ১৯তম অবস্থানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ২৯তম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ৩২তম এবং ৬৩তম অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। কিউএসের ২০২৪ সালের প্রকাশিত বিশ্বের ১ হাজার ৩৯৭টি টেকসই বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় সেরা এক হাজারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। এক হাজারের বাইরে বাংলাদেশের আরো চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অন্যদিকে কিউএস র‍্যাংকিং ২০২৪-এ প্রকাশিত এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৪০তম এবং বুয়েটের অবস্থান ১৮৭তম।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অবস্থান ১৯১তম। শুধু র‍্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়াই নয়,বিদেশী শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউজিসির প্রতিবেদন বলছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬৭৭ জন বিদেশী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী শিক্ষার্থীর হার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেশি। এখানে ৩৬টি দেশের ১ হাজার ৬০৪ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।

ইউনেস্কো বলছে বিশ্বজুড়ে সহিংসতা, বৈষম্য, বর্ণবাদ,জেনোফোবিয়া ও হেট স্পিচের যে বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে তাতে শান্তির প্রতি ওয়াদা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় জরুরি হয়ে পড়েছে। আর শিক্ষা সে শান্তি অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।

প্রতিবেদক : সফিকুল ইসলাম, সাংবাদিক ।

সম্পাদনা : আবদুল গনি
সহ-সম্পাদক ,চাঁদপুর টাইমস
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Share