দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন সমস্যার পাশাপাশি একবিংশ শতাব্দীর একটি বড় চ্যালেঞ্জ গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়া। শিক্ষা আমাদের মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফলে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ প্রয়োজন।
এ শিক্ষাব্যবস্থার সাথে শিক্ষকরাই সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই জাতীয়করণের দাবিটি শিক্ষকদের কাছ থেকেই এসেছে। এটি নিছক কোনো অমূলক দাবি নয়। বর্তমান সরকারের ২০১০ শিক্ষা নীতিকে এগিয়ে নিতে ও বাস্তবায়নে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ সময়ের দাবিতেও পরিণত হয়েছে।
১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তা উপলদ্ধি করেই প্রথম ধাপ হিসেবে ৩৭ হাজার প্রাথমিক স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকদের চাকুরি জাতীয়করণ করেছেন। ঐ স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই প্রাথমিক শিক্ষা আজ এ পর্বে এসেছে। ১৯৭৩ সাল থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে আন্দোলন সংগ্রাম,ধর্মঘট,বিক্ষোভ,রাজপথে মিছিল, মিটিং,সমাবেশ,মানববন্ধন,স্মারকলিপি পেশ,কালো ধারণ ও পতাকা উড্ডয়ন ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে ২০০৯ সালে শতভাগ বেতন ভাতায় এসে দাঁড়িয়েছে।
পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া, ইনক্রিমেন্ট, মেডিকেল ও অবসর সুবিধা,কল্যাণ ট্রাস্ট চালুসহ ধাপে ধাপে এর ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পে-স্কেল প্রাপ্তিত বেসরকারি শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হয়েছে।অথচ সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যের অবসান কমানো হয়নি। স্বাধীনতার এতোবছর পরও এ বৈষম্য থাকা বা রাখার কথা নয়।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল ও প্রায় সোয়া এক লাখ শিক্ষকের চাকুরি জাতীয়করণ করে জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করায় প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের কাছে তার অবদানের কথা মাইলফলক হিসেবে চিরভাস্বর থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী এখনো বিবেচনায় আনছেন না। স্বারকলিপির মাধ্যমে বেসরকারি স্কুল ,কলেজ ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে বৈষম্য দূরীকরণ করার আহবান জানান তারা ।
বর্তমান আন্দোলনে ১১ দফা বাস্তবায়নে দেশের ৯টি শিক্ষক সংগঠন এক কাতারে এসে আন্দোলনের কর্মসূচি পেশ করেছে। এদেশের ৯৫ ভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা পাঠদান করছে। বাকি ৫ ভাগ হয়তোবা সরকারি ও ক্যাডেট স্কুলগুলোতে অধ্যয়ন করছে।
একটি স্বাধীন দেশের সরকারকে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের বিষয়টি ধাপে ধাপে দূর করা উচিত বলে মনে করছে শিক্ষকরা। অতীতের সব সরকারই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবির প্রেক্ষিতে কম-বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন। বাড়ি ভাড়া,আংশিক উৎসব ভাতা,মেডিকেল ভাতা,অবসর সুবিধা ও শতভাগ বেতন উন্নতিতে শিক্ষকরা আন্দোলনের মাধ্যমে পেয়েছে।
শিক্ষকরা মনে করেন শিক্ষা জাতীয়করণ হলে শুধুমাত্র শিক্ষক ও কর্মচারীরাই লাভবান হবেন এমনটি নয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। সারা দেশে একই হারে শিক্ষার্থীগণ টিউশন,পরীক্ষা, বোর্ড ফি,রেজিস্ট্রেশন ও সেশন চার্জ এক অভিন্ন হারে প্রদান করার সুযোগ পাবে।
দেশের ২৫ হাজার মাধ্যমিক স্কুল কলেজ ও কারিগরির পোনে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে সরকারি- বেসরকারি যে বৈষম্য তাও দূরীভ‚ত হবে। এতে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। সারাদেশে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে ও শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে । এতে সরকারের শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে তড়িৎ গতি সৃষ্টি হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের ব্যবধান না কমালে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে বিঘœ সৃষ্টি হবে। কেননা দক্ষ ও শিক্ষিত জাতি গঠন ব্যতীত উন্নত দেশ ও জাতি গঠন সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নেও শিক্ষা জাতীয়করণের অপরিহার্য ভ‚মিকা রয়েছে । শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন করে তা করতে হবে। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য এর ভেতর অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ার কথা ছিল। ১৯৭৫ সালে পট পরিবর্তনে তা’আর হয়নি। পরবর্তী সরকারগুলো শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার মশগুলে ছিল। ফলে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর কথা ততটা ভাবেন নি।
শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণসহ ১১ দফা বাস্তবায়নে কেন্দ্রিয় ৯ সংগঠনের শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ১৪ মার্চ অজ্ঞাত কারণে সমাবেশ স্তগিত ঘোষণা করে আগামী ২০ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার জন্যে শিক্ষক সমাজের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
সারাদেশের ৯ টি শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত কেন্দ্রিয় শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রাম কমিটির ঘোষিত ‘ চল চল ঢাকায় চল’ কর্মসূচির আলোকে বুধবার (১৪ মার্চ) সকাল ১০ টায় ঢাকার কেন্দ্রিয় শহিদ মিনারে ওই শিক্ষক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। যার স্থান পরিবর্তিত হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে শিক্ষকগণ অবস্থান নেন।
ঐ মহাসমাবেশে চাঁদপুরের কলেজ শিক্ষক সমিতি, শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট, কারিগরি শিক্ষক সমিতি,মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি ও কর্মচারী ফেডারেশনের সকল জেলা-উপজেলা কমিটির সদস্যসহ সকল শিক্ষক-কর্মচারীগণ ঢাকার সুপ্রীম কোর্টের দক্ষিণ গেইটে ১৪ মার্চ বেলা সাড়ে ১১ টার মধ্যে সমেবেত হন। সেখান থেকে মিছিল সহকারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে সমেবেত হন।
এর আগে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিসহ ১১ দফা বাস্তবায়নে ঢাকায় সারদেশের ৯ টি শিক্ষক সংগঠন নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী কমিটি গঠন করে। ওই সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ডাকে শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলনের মাঠে উজ্জীবিত হন এবং দাবি আদায়ে জেলায়-উপজেলায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিনিধি সভায় ১৪ মার্চ শিক্ষক মহাসমাবেশের এ ডাক দেন এবং চল চল-ঢাকা চল কর্মসূচি হাতে নেয়।
সারাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে এ ব্যাপারে পোস্টার ও লিপলেট বিতরণ করা হয়।কেন্দ্রিয় শিক্ষক সংগ্রাম কমিটি ১৪ মার্চ ঢাকায় কেন্দ্রিয় শহিদ মিনারে সকাল ১০ টার মধ্যে দেশের মাধ্যমিক কলেজ ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের সমাবেশ ঘটানোর আহবান জানিয়েছিলেন।
অতীতের সকল শিক্ষক আন্দোলনের চেয়ে এবারের শিক্ষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট,ব্যাপ্তি ও ঐক্য বেশ মজবুত থাকা সত্তে¦ও স্থান সংকুলানের অভাবে ঢাকার শিক্ষকদের সমাবেশ স্থগিত হয়ে পড়ে। চাঁদপুরে শিক্ষক-কর্মচারীর ৫ টি সংগঠন ‘ শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণসহ ১১ দফা’ দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৪ জানুয়ারি সকাল ১০ টায় কেন্দ্রিয় কমিটির আহবানে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ও স্মারকলিপি প্রদান করেন।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ন্যায্য দাবি আদায়ে দেশের ৯টি শিক্ষক সংগঠন এ আন্দোলনের ডাক দেন। দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে-শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ,৫% বার্ষিক প্রবৃৃদ্ধি,পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা,বৈশাখি ভাতা, বাড়ি ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রধানশিক্ষক ও সহকারী প্রধানশিক্ষকের বেতন স্কেল সরকারি প্রধানশিক্ষক ও সহকারী প্রধানশিক্ষকদের মত প্রদান,পূর্ণাঙ্গ পেনশন সুবিধা বৃদ্ধি,শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬% ও জাতীয় বাজেটে ২০% বরাদ্দ,শিক্ষাবিভাগে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ৩৫% প্রেষণে নিয়োগ দান ,কারিগরি শিক্ষার মান- উন্নয়নে কারিগরি ও ভোকেশনাল বিশ্ববিদ্যালয স্থাপন ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা ইত্যাদি ।
চাঁদপুরের সাধারণ শিক্ষক ও কর্মচারীরা ও প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ ১১, ১২ ও ১৩ মার্চ অবিরাম ধর্মঘট পালন শেষে ১৪ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের সড়কে সমাবেশে যোগদান করেন। এর পূর্বে শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে শিক্ষকদের আন্দোলনের দাবিগুলোর স্মারক লিপির মাধ্যমে পেশ করেছেন।
সুতরাং , শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে সরকারি- রেসরকারি বৈষম্য দূর করতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে শিক্ষকরা প্রত্যাশা করছেন।
লেখক পরিচিতি : আবদুল গনি,সহ-সভাপতি, মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, চাঁদপুর
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৫:১০ পিএম, ১৬ মার্চ ২০১৮,শুক্রবার
ডিএইচ