ফরিদগঞ্জে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই বিষঘাতী ইটভাটা!

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ্যে আইন লঙ্ঘন করেই চলছে একটি অবৈধ ইটভাটা—যার কালো ধোঁয়ায় বিষিয়ে উঠছে চারপাশ, আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি। প্রশাসনের নীরব উপস্থিতিতে ‘MCB মাহাবুব চেয়ারম্যান ব্রিকস ফিল্ড’ আজ যেন আইন–আদালতের ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে।

গাজীপুর বাজার থেকে মাত্র ৫০–৬০ গজ দূরে এই অবৈধ ইটভাটা পরিবেশ আইন, ইটভাটা আইন এবং সরকারি নির্দেশনাকে প্রকাশ্যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। বারবার অভিযান, জরিমানা, নোটিশ—সবই যেন নাটকীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। বাস্তবে ভাটা বন্ধ হয়নি একদিনের জন্যও।

ইটভাটার কাজে আশপাশের ফসলি জমির উর্বরা টপ–সয়েল কেটে নেওয়া হচ্ছে, ফলে কৃষিজমি পরিণত হচ্ছে অনুর্বর মৃত মাটিতে। এলাকাবাসীর অভিযোগ—ভাটার বিষাক্ত বর্জ্য ও ধোঁয়ার কারণে ডাকাতিয়া নদীর পানিও ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে পড়ছে।

এ ভাটায় জ্বালানি হিসেবে নিয়ম বহির্ভূতভাবে পোড়ানো হচ্ছে গাছের গুঁড়ি এবং পোড়া মবিলের গাদ। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ঘন কালো বিষাক্ত ধোঁয়া, যা পুরো গাজীপুর এলাকাকে একটি “চলমান গ্যাস চেম্বার”-এ পরিণত করেছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কালি, শ্বাস নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু–বৃদ্ধ সবাই।

ইটভাটাটির মাত্র ৫০ গজ দক্ষিণে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা। প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনা এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির উপর দাঁড়িয়ে।

গাজীপুর মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা, মাথা ঘোরা নিয়ে ক্লাসে বসে থাকে। বেঞ্চ পর্যন্ত কালো হয়ে যায় ধোঁয়ার কালিতে। আমরা বারবার অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু প্রশাসন কার্যত নীরব।”

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, “এভাবে পোড়া মবিল ও কাঠ পোড়ানো সরাসরি ‘স্লো পয়জনিং’-এর শামিল। এই বিষাক্ত ধোঁয়া মানুষের ফুসফুস ধীরে ধীরে অকেজো করে দিচ্ছে। শিশু, গর্ভবতী নারী ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারসহ মারাত্মক রোগ অনিবার্য হয়ে উঠবে।”

বর্তমানে এই অবৈধ ইটভাটাটি ভাড়ায় চালাচ্ছেন ওই এলাকার কুদ্দুস পাঠান। ভাটার বৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,“উপজেলায় আমাদের মতো আরও ২০টির বেশি ভাটা চলছে। সবাই চালালে আমরা বন্ধ করব কেন? এখানে দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করে। বন্ধ হলে তাদের দায়িত্ব কে নেবে?”

প্রশাসন বহু আগেই ভাটাটিকে অবৈধ ঘোষণা করলেও বাস্তবে কোনো উচ্ছেদ হয়নি। স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রভাবশালী ‘অদৃশ্য শক্তির’ আশ্রয়ে প্রতিবছর নতুন করে চালু হচ্ছে এই ভাটা। প্রশাসনের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং সন্দেহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন,“খুব দ্রুত অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।”

ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেটু কুমার বড়ুয়া বলেন, “অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমরা দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

কিন্তু এলাকাবাসীর প্রশ্ন, এত বছরেও যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এবার কী ভিন্ন হবে? তাদের একটাই দাবি-এখনই উচ্ছেদ।

এলাকাবাসীর একটাই জোরালো দাবি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবসতি থেকে অবিলম্বে এই অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করা হোক। নচেৎ পরিবেশ রক্ষা নয়, এটা সরকার ও প্রশাসনের জন্যই বড় ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পরিণত হবে।

প্রতিবেদক: শিমুল হাছান,
১০ ডিসেম্বর ২০২৫