শাহরাস্তি

শাহরাস্তিতে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের ৩ ভাইয়ের মৃত্যু

চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে আর্সেনিকেই আক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের ৫ ভাইয়ের ৩ জন প্রান হারিয়েছে। বর্তমানে শুধু ওই পরিবারটি নয়, সমগ্র উপজেলার প্রায় সব অধিবাসীই আর্সেনিকের ঝুঁকিতে আক্রান্ত।

এ করুন বাস্তবতা তাড়া করছে, এ জনপদের ১০ টি ইউ’পি ও একটি পৌরসভার নাগরিকদের। আজ থেকে ২১ বছর পূর্বে দেশের সর্বোচ্ছ আর্সেনিক কবল অঞ্চল হিসেবে এ উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।তার পর থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সময় মতো নড়ে চড়ে না বসায় আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। যার ফলশ্রুুতিতে এ রোগের করাল গ্রাসে শাহরাস্তির একটি পরিবারটিকে জীবনের বড় ধরনের মূল্যে দিতে হয়েছে । সে জন্য অকালে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হলো পরিবারটির আপন তিন ভাই।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির ভাই হাবিবুর রহমান জানায়, ইতোমধ্যে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তাদের পরিবারের ৫ সহোদরের ৩ জন প্রান হারিয়েছে। এক সময় পরিবারটির সবই ছিলো। ছিলো তাদের ভাইদের পাঁচ টি তাজা প্রান, ছিলো সুখ, শান্তি, আনন্দ । আজ তার কিছুই অবশেষ নেই। ওই ৫ ভাইয়ের সংসারের শুধু বেধনাই আজ সম্বল।সম্প্রতি তাদের তৃতীয় ভাইও আর্সেনিকের সেকো বিষের কবলে পড়ে ধুঁকে ধুঁকে প্রান হারিয়েছে। জীবিত দু ভাইয়ের প্রানও আজ ওষ্ঠাগত।

এমন করুন বাস্তবতা তাড়া করছে শাহরাস্তি উপজেলার পৌরশহরের ৭ নং ওয়ার্ডের তালুকদার বাড়ি মৃত মমতাজ উদ্দিনের পরিবারে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি জানায়, ওই বাড়িতে মৃত মমতাজ উদ্দিনের পরিবারে পর্যায় ক্রমে ৫ ছেলে ৩ মেয়ে বড় হয়। এক সময় মেয়েরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পর্যায় ক্রমে চলে যায় স্বামীর বাড়িতে। ওই পরিবারের বাকী ৫ সন্তান (ভাই) থেকে যান নিজ বাড়িতে।

১৯৭৬ সালে তাদের বাড়ির নিকট মসজিদের পাশে স্থাপিত একটি টিউবওয়েলের পানি বেঁচে থাকার প্রয়োজনে পান করে আসছিলো। পরে ১৯৮৬ সালে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লে নিজ পরিবারের আঙিনায় একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে তার পানি পান করা শুরু করে।

পরিবারটির প্রথম (বড়) ভাই রহুল আমিন মানিক (৫৫) বি,কম স্থানীয় শাহরাস্তি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি জুটিয়ে নেন। ১৯৯১ সালে একটি এনজিওর মাধ্যমে প্রথম সনাক্ত হয় তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত। ২০০৪ সালে ঢাকার আইসিডিডিআর,বিতে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষায় করে শত ভাগ নিশ্চিত হন আর্সেনিক তাকে কতটা গ্রাস করেছে।২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ তারিখ শুক্রবার তিনি আর্সেনিকের ছোবলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অবিনশ্বরে পাড়ি জমান। তৃতীয় ভাই মোঃ মজিবুর রহমান (৪৮) একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরি করতেন। তিনি জানতেন না,একই ভাবে তাকেও আর্সেনিকের অক্টোপাস গিলে বসে আছে।যখন যানলেন তখন তো আর সময় নেই। এরই মধ্যে তার শরীরের গুরুত্ব পূর্ণ অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে।

২০১৭ সালের অক্টোরের ১৯ তারিখ বৃহস্পতিবার তিনি মৃত্যুর নিকট হেরে যান। দ্বিতীয় ভাই নুরুল আমিন (৫৫) বাড়ির পার্শ্বে তালতলা নামক স্থানে একটি চা স্টল দিয়ে বসেন। তিনি দু ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়া দেখে নিজ স্বাস্থ্য নিয়ে নড়েচড়ে বসেন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারেন, তিনিও আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত।তখনই তিনি ঢাকায় মহাখালীতে ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারেন, তার শরীরেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে। এর পর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে চা স্টলে দিন কাটাতেন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ মঙ্গলবার তার জীবন প্রদীপটিও নিভে গিয়ে তিনি ভাইদের মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হন।

গত রবিবার তাদের বেঁচে থাকা আর্সেনিকে আক্রান্ত ছোট ভাই হাবিবুর রহমান (৪৩) জানান, সবইতো হারালাম, এখন এ রোগের দহন নিয়ে আমার চতুর্থ ভাই মফিজুর রহমান (৪৫)আর আমি কোনমতে বেঁচে আছি।বর্তমানে ওই জনপদের শুধু এ পরিবার নয় ভূক্তভোগিরা আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করে কেউ জীবন, কেউ সংসার হারাচ্ছেন। পার্শ্ববর্তী কচুয়া উপজেলার জনৈক গৃহবধূ নাহিদা (৩৩) ইউনিডো’র এনজিওতে আর্সেনিক চিকিৎসা করিয়েও স্বামী ও সংসার টিকাতে পারেনি।বর্তমানে শাহরাস্তির আয়নাতলী গ্রামের গনমাধ্যম কর্মী হেলাল উদ্দিন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে দু,টি কিডনি বিকল হওয়ার পথে। অনেকে আর্সেনিক যুক্ত পানি দীর্ঘ মেয়াদে পান করে, শরীরে নানান অসূখে বাসা বাঁিধয়ে চরম অসুস্থতা নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এর ডাঃ অচিন্ত্য চক্রবর্ত্তী জানান, ২০১২ সালের পর থেকে সরকারি ভাবে কোনো ঔষধ সরবরাহ করা হচ্ছে না। আমরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছি। তারা বাহির থেকে ঔষধ কিনে খাচ্ছে। ২০১৭ ডিসেম্বরে ৫হাজার ৬শ ৫৫ জন রোগীর শনাক্ত করনের হিসেব পাওয়া যায় । সর্ব শেষ হিসাবে ২০১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো ১৪ জন রোগী সনাক্ত করা হয়।

শাহরাস্তি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস সিসিটি অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব আঃ হালিম জানান, ১৯৯৬ সালে প্রথম আর্সেনিক সনাক্ত হয়। তার পর থেকে এ পর্যন্ত শাহরাস্তি উপজেলায় ১ হাজার ৭শত ৮৫ টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সচল রয়েছে ১ হাজার ৭শত ৪৫ টি এবং বিকল রয়েছে ৪০টি।

এ ব্যাপারে পৌর মেয়র হাজী আঃ লতিফ জানান, সম্প্রতি দেশের ৪০টি পৌরসভার সঙ্গে শাহরাস্তি পৌরসভায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান স্থাপন করার লক্ষ্যে ও গ্রোথ সেন্টারে অবস্থিত পানি সরবরাহ ও এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় এ পৌরসভায় ভূপৃষ্ঠস্ত পানি শোধনাগার ও উচ্চ জলাধার নির্মান কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে ।

এ জনপদে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি সম্পর্কে সংশি¬ষ্টরা জানান, অত্র উপজেলায় পল্লী বিদৎুতের বিষাক্ত খুটির পর্যাপ্ত অপসারন, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাক্তি পর্যায়ে শ্যালোমেশিন ও গভীর নলকূপ বসানোর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।এতে সুপেয় খাবার পানির যোগানের একমাত্র ভূগর্ভস্থ উৎসটি হয়ে পড়ছে অনিরাপদ।

স্টাফ করেসপন্ডেট
১৫ এপ্রিল,২০১৯

Share