মহান ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব দ্যুতি ছড়াচ্ছে। নূতন প্রজন্মের মধ্যে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে সঙ্গে দেশাত্মবোধ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যে চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়োজনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকা বাঞ্ছনীয়। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরেও দেশের অন্যান্য জেলার মত চাঁদপুরেও তা পূর্ণতা পায়নি। জেলার ৯শ’৪৩ বিদ্যালয়ে গড়ে উঠেনি শহীদ মিনার। এ তালিকায় ৮শ’৮৫ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ৫৮টি হাইস্কুলও রয়েছে।
অথচ শহীদ মিনার কেবলমাত্র ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি স্মারকই নয়। এটি সকল অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনন্য প্রতীক। এই ভাষা সংগ্রামের সুবর্ণ পথ ধরে সূচনা হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের। রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলোও চাঁদপুরে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা লক্ষ করা গেছে।
চাঁদপুরের জেলার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চাঁদপুরে ২শ’৯৩টি হাই স্কুলের মধ্য ৫৮টি এবং ১১শ’ ৫৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮শ’৮৫টি বিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিণার। তবে আশার কথা হলো মতলব উত্তরে উপজেলা উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্কুল কমিটির সমন্বয়ে ১শ’ ১৮টি স্কুলে শহীদ মিণার নির্মাণ কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানায়, আমরা আমাদের নিজেদের স্কুলে ভাষা শহীদদের স্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। তাছাড়া জেলায় কোথায় ভাষা শহীদদের নাম ফলক তাও আমাদের জানা নেই। এ জেলার কারা ভাষা শহীদ বা ভাষা আনন্দোলনে লড়াই সংগ্রাম করেছেন তাদেরকেও সবাই ভুলতে বসেছে।
চাঁদপুর সদরের বাবুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপন কুমার রায় চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘শিশুরা ভাষার মাস সম্পর্কে জানতে চায়। তারা এই ফেব্রুয়ারী মাসের ২১ তারিখ দিনটিতে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চায়। আর সেটা স্কুল প্রাঙ্গণে করে দিতে আকুতি জানাচ্ছে বলেই আমরা বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাথে কথা বলে শহীদ মিণার নির্মানে উদ্যোগ নিচ্ছি।’
চাঁদপুর জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল বাবুল চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের পটভূমি শহীদ মিণার দেখলেই স্মৃতিতে ভেষে উঠে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি স্কুল প্রাঙ্গণে তাই শহীদ মিনার নির্মাণ জরুরী।’
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সাহাব উদ্দীন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, প্রাথমিক স্কুলগুলোতে সরকারি কোন বরাদ্দ নেই শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য। তবুও আগের চেয়ে এখন প্রাথমিক স্কুল গুলোতে স্থায়ী শহীদ মিণার বেড়েছে। আমরা স্কুল কমিটিকে শহীদ মিনার নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করছি। তারা সরকারি অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী তারা শহীদ মিনার নির্মাণ করছেন। শহীদ মিনার স্কুলগুলোতে থাকলে ভাষা শহীদদের ইতিহাস শিক্ষার্থীদের সামনে ভেষে উঠবে এবং এতে তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ গিয়াস উদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে স্কুল প্রাঙ্গণগুলোতে শহীদ মিণার নির্মাণ কাজ চলমান। মাদ্রাসাগুলোতেও শহীদ মিণার নির্মাণ করতে মনিটরিং করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনসহ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে স্কুল কলেজে শহীদ মিণার থাকার বিকল্প নেই।
চাঁদপুর জেলা শিক্ষা প্রকৌশলী ফাহিম ইকবাল বলেন, আমরা স্কুলগুলোর সংস্কারের বরাদ্দ থেকে শহীদ মিণার নির্মাণ করতে হয়। শুধুমাত্র শহীদ মিণার নির্মাণে আমাদের নির্দিষ্ট প্রকল্প থাকা জরুরী।
এ বিষয়ে জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ ইকবাল হোসেন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ২০১৬ অর্থ ববছর থেকে চাঁদপুর জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বমোট ১ কোটি ৬৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে জেলা ৭৪টি স্থায়ী শহীদ মিণার নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ লক্ষ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে চাঁদপুর সদরে ৭টি, ৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে হাইমচরে ২টি, ৩৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ফরিদগঞ্জে ১৫টি,১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে হাজীগঞ্জে ৮টি,১৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে শাহরাস্তিতে ৫টি, ৪৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে কচুয়ায় ১৯টি, ৩১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মতলব উত্তরে ১২টি এবং ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মতলব দক্ষিণে ৬টি।
এ বিষয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ওচমান গণি পাটওয়ারী চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গকারী ভাষা শহীদদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। রাজপথে তাঁরা সেসময় ছিলেন বলেই হয়ত বাংলা ভাষার মতো এমন সুমধুর ভাষায় আমরা এখন কথা বলতে পারছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমি কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, এবার আমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিণার করে দিয়েছি। যেই স্কুলগুলোতে শহীদ মিণার নির্মাণ এখনো হয়নি সেগুলোতে আগামীতে নির্বাচিত হলে মাধ্যমিকগুলো ১ম ধাপে এবং প্রাথমিকেরগুলো ২য় ধাপে করে দিবো ইনশাআল্লাহ। সর্বপরি আমি সকল ভাষা শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং এখনো জীবিত যেই সব বীর ভাষা সৈনিকগণ রয়েছেন তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur