জাতীয় কবির রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পূর্ণ হলো

আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত এবার ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষপূর্ণ হলো। এ বছরের ডিসেম্বরে নজরুলের দেশকাঁপানো এ বিদ্রোহী কবিতা রচনার শতবর্ষ। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে পৃথিবী জুড়েই নজরুল প্রেমীরা নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন।

বৃটিশদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার,নিপীড়ন ও জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আহবান জানিয়েছেন প্রিয় কবি নজরুল। বিদ্রোহী কবিতাটি কবি নজরুল লিখে সে সময়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের জবাব দেন। একই সাথে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। যারা সব কিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এবং শৃঙ্খল পরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো।

পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে তরুণ সমাজকে সু-শৃঙ্খল হতে সহায়তা করেছিল বিদ্রোহী কবিতাটি। জীর্ণশীর্ণ ও দু’বছরের একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে বিদ্রোহী কবিতার ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবিতাটি কতটুকু চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।

১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে প্রিয় নজরুল আবহাওয়া জনিত কারণে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ফলে তিনি দেহঘরে বেড়াতে যান। এ সময়ে নজরুলের ঐ সময়ের একটি রচনাটি-মোসলেম ভারতে প্রকাশের জন্য ও আফজালুল হককে একখানা পত্রিকারের প্রকাশের কথা বলেন।

কবি নজরুল ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পাকিস্থানের করাচি থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ফলে সর্বপ্রথম কলিকাতায় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে পরিচয় হয় এবং তাঁর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।

বিদ্রোহী কবিতার রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে জানা যায়–১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে ৩-৪ সি তালতলা, কলকাতা-১৪ লেনের বাড়ির নিচ তলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ঘরে বসে শেষ রাতে নিবিড় পরিবেশে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করার পর নামকরণ করেন ‘ বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতা তাঁর বন্ধু কমরেড মুজ্জাফর আহমেদ।

কাজী নজরুল ইসলাম একশ’ বছর আগে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে (সম্ভবত: ২৪ ডিসেম্বর শেষ রাতে) কলকাতার মৌলালি অঞ্চলের কাছে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে পেনসিলে রচনা করেন কালজয়ী এ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। বিদ্রোহী কবিতাটিতে ১৪টি ছোট-বড় স্তবক, ১৪১টি লাইন বা পংক্তি এবং ১৪৫ বার ‘আমি’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। ‘আমি’ দ্বারা তিনি হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন-ভারত বর্ষের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি।

প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বা বঙ্গাব্দ ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ তারিখে। এরপর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় পত্রিকাটি অনিয়মিত হওয়ায় ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসের পরিবর্তে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারও ছাপা হয়।

বল বীর উন্নত মম শির ..

প্রকাশের পরের দিন কবি নিজেই বিজলী পত্রিকার ৪ টি কপি নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুটিরে গিয়ে আবৃত্তি করে শুনান। এতে কবিগুরু অভিভূত হন এবং তিনি বলেন,‘তুমি অনেক বড় কবি হতে পারবে। ’সেই থেকে তাঁর নাম চারদিকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে বিদ্রোহীকবি বলে স্বীকৃতি লাভ করেন।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার এ পুন: পুন: প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে।একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’এবং মাসিক‘বসুমতী’ এবং পরের বছর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘সাধনা’য় পুন:প্রকাশিত হয়।

বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতা ছিলেন নজরুলের এ বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমদ। নজরুল ভোরেই তাঁকে কবিতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন,‘ আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বড়দিনের ছুটিতে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। তখন নজরুল ও আমি নিচের তলার পূর্ব দিকের বাড়ির নিচে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে থাকি। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন রাতে। রাতের কোন সময় তা জানি না। রাত ১০ টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল -সে একটা কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটিই সে আমাকে পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। আমার মনে হয়- নজরুল শেষ রাতে কবিতাটি লিখেছিল।’

বিদ্রোহী কবি তিনি কবিতার ভাষায় বলতে চেয়েছেন কারো অধীন হয়ে নয়-বরং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের সার্থকতা। ভাব-ভাষা ও উপমা-ছন্দে বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত এক অনবদ্য রচনা। বিদ্রোহী কবিতাটি যখন তিনি রচনা করেন-তখন ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং এক উত্তাল হাওয়া বিদ্যমান ছিল। গোটা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। এর মধ্যেই তার কালজয়ী রচনা‘বিদ্রোহী’।

বিদ্রোহী কবিতা নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ১২ টি কবিতার একটি। ‘বিদ্রোহী’ এ কাব্যের দু’নম্বর কবিতা। ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সাথে সাথে নজরুলের খ্যাতি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তার নাম হয়ে যায়। কবিতাটি হয়ে ওঠে নজরুলের কাব্যমূর্তির প্রতীক।

১৯২২ সালের জানুয়ারি কবিতাটি অবিন্যাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত তৎকালীন ‘সাপ্তাহিক বিজলী’পত্রিকায় দেন। পরে মসলেম ভারত পত্রিকার সম্পাদক আজজালুল হক প্রিয় কবিকে অনুরোধ করলে তিনি তারঁ কাছে রাখা পেন্সিল দিয়ে লেখা কপিটি ছাপাতে দিয়ে দেন। কলকাতা ৩/৪ সি, তালতলা লেন,কলকাতা-১৪ বাড়িটি ছিল তখন‘রাজেন্দ্র কুঠির’ নামে। পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে হয় সীমা সাহার বাড়ি’। বর্তমানে‘নজরুল স্মৃতি কক্ষ’ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে।

১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। বস্তত:এ কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সাড়া জাগানো ঘটনা।

পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা, ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। বিশেষ করে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতা ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী,হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন ধ্বনি। কবির রচিত অগ্নীবীণা কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহী কবিতাটি অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ হবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘বিদ্রোহী ’কবিতার শতবর্ষ পূর্তি।

এদিকে নার্গিসের সাথে ঘর না বাঁধলেও নার্গিসই ছিলেন তার প্রথম প্রেম। ‘নার্গিস’ নামটিও নজরুলেরই দেয়া। দৌলতপুর মুন্সীবাড়ির পুকুর পাড়ে এক সকালে তাকে দেখে নজরুল জানতে চাইলেন নাম। মেয়েটি নাম বলল সৈয়দা খাতুন। এত সুন্দর চেহারায় এ নাম মানায় না। নজরুল নাম দিলেন নার্গিস। পারস্য দেশের কবি হাফিজের প্রিয় ফুল ও ঐ দেশের লতাপাতার ফুলের নাম এটি। সে দেশে আমার এক প্রিয় কবির কবি হাফিজ। তাঁর কবিতায় এ ফুলের নাম আছে। কিন্তু বিয়ের পর তাদের বিচ্ছেদ নজরুলের মনে গভীর ক্ষত ও স্থায়ী বেদনার সৃষ্টি করেছিল।

নজরুলের বহু গান ও কবিতায় নজরুল-নার্গিস প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। ষোলো বছর পর কলকাতায় একবার তাদের দেখা হয়েছিল। আবেগে দু’জনই তেমন কথা বলতে পারেননি। নজরুল শুধু বললেন,নার্গিস বাড়ি চলে যাও। প্রমীলা ও তার মা তোমাকে ভালোভাবে নেবে না।

নার্গিসের সাথে ১৯২১ সালের ১৮ জুন নজরুলের পরিচয় ও বিয়ে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিয়ের রাতেই নজরুল নার্গিসের দৌলতপুরের বাড়ি (মুরাদনগর) ত্যাগ করেন। নজরুল-নার্গিস বিয়ের বিষয়টি রহস্যাবৃত থেকে যায়। নার্গিসের বাড়ি থেকে চলে গিয়ে নজরুল প্রমীলাদের বাড়িতে একপক্ষকাল অবস্থান করে কলকাতায় ফিরে যান।

বাংলাদেশের জাতীয়কবি কাজী নজরুল ইসলাম-বিদ্রোহী কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিতি সাহিত্য চর্চার দিনগুলোতেই পান। তাঁর এ বিশেষ বিশেষণ টি তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত হয়‘ বিদ্রোহী কবিতা’ রচনার মধ্য দিয়ে । এ কবিতাটি লিখে তৎকালীন কলকাতা যথা বাংলা-ভারত বর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করেন প্রিয় কবি নজরুল। তাই বলা যায়-বিদ্রোহী কবিতা লিখেই নজরুল বিদ্রোহী কবি হয়ে যান।

বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে এমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবিখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিতে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপে যে খ্যাতি অর্জন করেন, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর নজির নেই।

শতবর্ষী একটি কবিতাই এ আলোচনার বিষয়। কলকাতায় ফিরে গিয়েই রচনা করেন তার ঐতিহাসিক ‘ভাঙার গান’- কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’ ও বিদ্রোহী কবিতা- ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির।’ বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি।

বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবিখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিতে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপে যে খ্যাতি অর্জন করেন, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর নজির নেই।

যতদুর জানা যায়- বিদ্রোহী কবিতাটি ৩৩ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি এবার ভারতীয় উপমহাদেশের ১শ ’টি ভাষায় অনুবাদের আয়োজন চলছে। শতবর্ষ উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট ‘বিদ্রোহী’ নামে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করবে।

তথ্যসূত্র: মো.হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল,নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায়‘কাজী নজরুলের জীবনী এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি)

লেখক :আবদুল গনি, শিক্ষক ও সাংবদিক, চাঁদপুর টাইমস ও সাধারণ সম্পাদক, নজরুল গবেষণা পরিষদ, চাঁদপুর।

১৫ মে ২০২২

Share