চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক :
বড় বোন মরিয়ম আক্তার স্বামী পরিত্যক্ত, ছোট বোন মর্জিনা আক্তার স্বামীর বহুবিয়ে ও নির্যাতনের শিকার। সময়ের ব্যবধানে দু’জনই স্বামীর বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন দিনমজুর বাবা বাচ্চু মিয়ার বাড়িতে। বাচ্চু মিয়ার অভাবের সংসার। তাই দু’জনই পাড়ি জমিয়েছিলেন দূর প্রবাস লেবাননে। কিন্তু সেখানে গিয়েও সুখ হল না হতভাগ্য এ দুই বোনের।
সুখের সন্ধান পেয়েও হারাতে হল বাচ্চু মিয়াকে। কারণ, মাস খানেক আগে তার ছোট মেয়ে মর্জিনা বেগম খুন হয়েছেন। আর এ খুনের অভিযোগ বড় বোন মরিয়মেরই ঘাড়ে। পুলিশ মরিয়মকে আটক করে আসসাফিয়া কারাগারে রেখেছে।
হতভাগ্য দুই নারীর বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা গ্রামে।
গত সোমবার (৬ জুলাই) বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন বাচ্চু মিয়া। ছোট মেয়ের খুনের বিচার ও ‘নিরপরাধ’ বড় মেয়েকে জেল থেকে বের করে আনার আকুতি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে গিয়েছিলেন তিনি।
বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘গত ৬ জুন মরিয়মকে আটক করে পুলিশ। তবে বাচ্চু মিয়ার অভিযোগ মরিয়ম নয়, তার ছোট মেয়েকে খুন করে পালিয়েছে কুমিল্লার রাসেল।
তিনি আরও বলেন, ‘দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। ছোট ছেলে চট্টগ্রামে থাকে, বাড়িতে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। বড় মেয়ে মরিয়ম স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার পর বাড়িতে চলে আসে। অভাবের সংসার। মাটি কেটে কখনও দিনমজুরি করে আমাদের সংসার চলছিল। প্রায় তিন বছর আগে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে মরিয়মকে লেবাননে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু মরিয়মের ওপর অনেক নির্যাতন করত তার মালিক। তাই দুই বছর পুরনো মালিক ছেড়ে নতুন এক মালিকের কাছে চাকরি শুরু করে মরিয়ম।
তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে মরিয়ম যে টাকা পাঠাত তা দিয়ে ভালই চলছিল সংসার। কিন্তু, এরই মধ্যে ছোট মেয়ে মর্জিনার ওপর তার স্বামীর নির্যাতনটা আরও বেড়ে গেল। মর্জিনাকে রেখে আরও পাঁচটি বিয়ে করেছে তার স্বামী। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ৯ বছরের মেয়েকে নিয়ে মর্জিনাও আমার বাড়িতে ফিরে এলো। ১০ মাস আগে বাড়ির পাশের চার শতাংশ জমি বিক্রি করে রাসেলের মাধ্যমে কুমিল্লার মর্জিনাকেও বিদেশে পাঠিয়ে দেই।’
রাসেল সম্পর্কে জানতে চাইলে বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘তার বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা পরিষদের পূর্বপাশে। বাবার নাম তাজুল ইসলাম। সে বিদেশে লোক নেয়। লেবাননে বড় মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ওই পরিচয় থেকেই রাসেলে ছোট মেয়েকে নিয়ে যায়।’
মর্জিনাকে বৈধভাবে না অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়া হয় এমন প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম-মর্জিনার বাবা বলেন, ‘আমরা তো জানতাম কাগজপত্র ঠিক আছে। কিন্তু, লেবাননে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় মর্জিনা আমাদের ফোন দিয়ে জানায়, তাকে অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাসেল ও মর্জিনা লেবাননে একই ফ্ল্যাটে থাকত। তাদের থেকে দূরে অন্য এলাকায় থাকত বড় মেয়ে মরিয়ম। মরিয়ম বাড়িতে টাকা-পয়সা দিলেও মর্জিনা দিত না। সে সব টাকা রাসেলের কাছেই জমা রাখত। কারণ রাসেল আশ্বাস দিয়েছিল, তার কাছে টাকা-পয়সা নিরাপদেই থাকবে।’
বেশ কিছুদিন ধরেই মোবাইল বন্ধ থাকে মর্জিনার। মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পেরে গত ৬ জুন মর্জিনার বাসায় যায় বড় বোন মরিয়ম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন বাসায় বাইরে থেকে তালা লাগানো। ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এ সময় রাসেলের ফোনও বন্ধ পায় মরিয়ম। ফোন দেয় রাসেলের লেবানন প্রবাসী ভগ্নিপতিকে। সে মরিয়মকে জানায়, রাসেল তো দেশে (বাংলাদেশ) চলে গেছে। এতে সন্দেহ ঘনীভূত হয় মরিয়মের। এরই মধ্যে বাসার মালিক বেরিয়ে এলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন মরিয়ম। দরজা ভেঙে ভেতরে গিয়ে দেখেন ছোট বোন মর্জিনার গলিত লাশ। কিন্তু, বাসার মালিক পুলিশকে খবর দিয়ে মরিয়মকেই ধরিয়ে দেন। মরিয়ম এখন জেলহাজতে আছে। মর্জিনার লাশ রয়েছে মর্গে।
বাচ্চু মিয়ার দাবি, মর্জিনাকে হত্যা করেছে রাসেলই। কারণ মরিয়ম তো দূরে থাকত। রাসেলের কাছেই থাকত মর্জিনা। মর্জিনা রাসেলের কাছে অনেক টাকা জমা রেখেছিল। আমার মনে হয়, টাকার জন্য চাপ দেওয়ার কারণেই রাসেল তাকে খুন করেছে— যোগ করেন বাচ্চু মিয়া।
রাসেলের পরিচয় চানতে চাইলে বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘বড় মেয়ে মরিয়মের সঙ্গে রাসেলের পরিচয় ছিল। মরিয়ম জানিয়েছিল, সে খুব ভাল ছেলে। রাসেলের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা পরিষদের পূর্ব পাশে। তাদের দুই তলা বিল্ডিং আছে। বড় মেয়ের তথ্যানুযায়ী আমি সরেজমিন রাসেলের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার তথ্যের সত্যতা পেয়েছি।’
দুই মেয়ের এমন পরিণতির কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন হতভাগ্য বাচ্চু মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমার কিছুই নাই। দিন এনে দিন খাই। বড় মেয়েটা টাকা পাঠাত। এখন কী করে সংসার চলবে? আবারও মাটি কাটতে হচ্ছে।’
বাচ্চু মিয়ার দেওয়া ঠিকানানুযায়ী রাসেলের কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে মরিয়ম ও মর্জিনার বাবা বাচ্চু মিয়ার তথ্যানুযায়ী বুড়িচং উপজেলার পূর্ব পাশে দুই তলার বাড়িটিই রাসেলেদের। তবে, বাড়িতে গিয়ে রাসেল এবং তার স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। কোথায় গেছেন প্রতিবেশীরা তা জানাতে পারেননি। তাদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ।
রাসেলের বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাসেল ১৫-২০ দিন আগে লেবানন থেকে দেশে এসেছে। চলতি মাসের ২৫ তারিখে আবার চলে যাবে বলে শুনেছি। তবে, তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই।’
কেন সম্পর্ক নেই জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর সঙ্গে আমাদের মেলে না। তাই অনেক দিন ধরেই ওর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
রাসেলের প্রতিবেশী যুবক রিপন বলেন, ‘সে (রাসেল) কিছুদিন আগে বিদেশে থেকে এসেছে। মাঝেমধ্যে কিছু লোককে বিদেশে নিয়েছে বলে জানি। তবে, তার সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনিনি।’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সহকারী পরিচালক জাহিদ আনোয়ার বলেন, ‘বাচ্চু মিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার অভিযোগ লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। তারা খোঁজ-খবর নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।’
আপডেট : বাংলাদেশ সময় : ০২:৩৪ অপরাহ্ন, ২৪ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার ০৮ জুলাই ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম–এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি