জাতীয়

লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য চাকুরিই যেনো না হয়

ফিচার : 

মিজানুর রহমান রানা  | আপডেট: ১০:৫০ অপরাহ্ণ, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বৃহস্পতিবার

‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটি যেন একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এ কথাটি আমরা সবাই বিশ্বাস করি। কারণ শিক্ষাবিহীন জাতি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর সমান। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি একটি জাতিও শিক্ষা ছাড়া কোনো প্রকার উন্নতি সাধন করতে পারে না। অথচ আমাদের সমাজে আজকাল প্রতিটি তরুণেরই লক্ষ্য যেন এই একটাই, তা’ হচ্ছে লেখাপড়া শেষে একটি ভালো চাকুরি। এই ধারণা যেন প্রতিটি তরুণের মাঝে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্যটাই হচ্ছে চাকুরি করার জন্যে নিজেকে তৈরি করা। আর শুধু চাকুরি করাই নয়, তার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হচ্ছে এমন চাকুরি- যা বিশাল অংকের বেতনও নিশ্চিত করবে। পড়াশোনার মূল লক্ষ্য যে জ্ঞান অর্জন; যে জ্ঞান তাকে সমৃদ্ধ করবে ভবিষ্যৎ চলার পথ, আলোকিত করবে তার সমাজ তথা দেশকে- এমন ধারণা তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই আজকাল পোষণ করে না। দেশের সামাজিক কাঠামো এমনভাবেই গড়ে উঠেছে যে, লেখাপড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য তরুণ প্রজন্মের মনে জন্মাবার সুযোগটাও নেই।

‘আজকের তরুণ আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ এমন কথা সবাই মুখে উচ্চারণ করলেও কাজে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তরুণদের গড়তে কী একটা সুষ্ঠু শিক্ষা কাঠামো সম্পন্ন হয়েছে? এমন প্রশ্ন নিয়ে দেশের রাজনীতিবিদ, সমাজচিন্তাবিদ, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে যে, জ্ঞান অর্জনের জন্যে যে শিক্ষা পদ্ধতি, তা’ আমরা তৈরি করে দিতে পারিনি তরুণ প্রজন্মের সামনে। অদূর ভবিষ্যতে যে পারা যাবে, এমন আশার কথাও বলতে পারেননি কেউ। এর মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, শিক্ষার দুর্বৃত্তায়ন, শিক্ষার রাজনীতিকরণ- এই তিনটি মিলে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট হয়েছে। ফলে তরুণরা ধাবিত হচ্ছে যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জনের দিকে।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আমরা আজো বের হয়ে আসতে পারিনি। তখন একশ্রেণীর কেরানি তৈরির জন্যে শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। বর্তমানে দেশে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে, এখন সেই পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্যে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে লেখাপড়ার প্রসার ঘটছে। বাংলাদেশের মাটি, প্রকৃতিনির্ভর যে শিক্ষা ব্যবস্থা তা’ আজ পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা বিচার করে তার ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

এ ব্যাপারে একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জানান, বাবার ইচ্ছা আমি ডাক্তারি পড়ি। আর মা চান যা পড়লে ভালো বেতনের চাকুরি পাওয়া যাবে আমি তেমন কিছু পড়ি। আমি অংক করতে ভালোবাসি। আমি অংক নিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু সেটা মা-বাবা কেউ একদিনও জিজ্ঞেস করেননি তুমি কী পড়তে চাও। ফলে এখনকার ট্রেন্ড বিবিএ’তে ভর্তি হলাম। এখন যেন সবাই খুব খুশি।

অন্য একজন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী মেহজাবিন তানজিলা জানায়, আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসি। কিন্তু পড়াশোনা করবো বিবিএ’তে। কেন? পেইন্টিং নয় কেন? তানজিলার সাফ জবাব, ওই বিষয়ে পড়লে ভালো চাকুরি মিলবে না। ছবি আঁকা আমার শখ। কিন্তু ক্যারিয়ার করবো অন্যদিকে।

দেখা যায়, শুধু লেখাপড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্য ধারণা পোষণের ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই দায়ী করা যায় না। বরং এ ব্যাপারে আমাদের দেশের বাবা মায়েরাও যে কিছুটা দায়ী তা উপরোক্ত দু’জন ছাত্র-ছাত্রীর কথায় পরিষ্কার অনুধাবন করা গেলো। বাংলাদেশের জনসম্পদ সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই সম্পদকে কাজে লাগাতে হলে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। যে লেখাপড়া করতে চায় তাকে যেমন সুযোগ করে দিতে হবে, যে কাজ করতে চায় তার জন্যেও কর্মমুখী পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন আজ সনদমুখী হয়ে পড়েছে। শিক্ষার বিস্তার ঘটানো আর তাকে সস্তা করে ফেলা এক বিষয় নয়। একজন শিক্ষার্থীকে মননশীল, যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেই। এতে শিক্ষার বিস্তার ঘটছে কিন্তু মান বাড়ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থার এই যে দুরবস্থা এর আরেকটা কারণ- এই শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠে পরে যারা শিক্ষকতা শুরু করেছেন তাদের মধ্যেও নেই সেই মননশীলতা। ফলে এই শিক্ষক শ্রেণীর হাতে পড়ে এখন পড়াশোনা হয়ে পড়েছে নোটনির্ভর, কোচিংনির্ভর।
অন্যদিকে বলা চলে, একজন তরুণ লেখাপড়া করে চাকুরি করবে, এতে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমরা কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাই তরুণ প্রজন্মের সামনে দিতে পারিনি। সাধারণ বিএ, এমএ পাস করে চাকুরি পাওয়া যে সম্ভব নয়, এটা আমরা সবাই জানি। তারপরও সবাই সুযোগের অভাবে সেই বিএ, এমএ পাস করে চাকুরির বাজারে জায়গা করে নেবার জন্যে অহর্নিশ শক্তিক্ষয় করে ক্লান্ত, অবসন্ন। সুতরাং যে তরুণ কাজ করতে চায়, তার জন্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের পরই দ্রুত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্যে নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার বা কাজ শেখার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আর যারা উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে চায় বা যাদের যোগ্যতা রয়েছে তাদের জন্যেও চাই সেই বিশেষ সুযোগের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।

পরিশেষে বলা যায়, একটি শিশু ছোটবেলা থেকেই তার চারপাশে দেখছে সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক পরিবেশ। সে দেখছে, সমাজ তাকেই মর্যাদা দিচ্ছে যার টাকা আছে। যার জ্ঞান আছে সে যেন অনেকটা করুণার পাত্র। এই স্বেচ্ছাচারী অর্থনীতি তাকে শেখাচ্ছে টাকা না থাকলে সমাজে কোনো অবস্থান নেই। এখানে পড়াশোনার কোনো প্রয়োজন নেই। ফলে তারা ক্ষমতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ধাবিত হচ্ছে অর্থ উপার্জনের দিকে- জ্ঞান অর্জনের দিকে নয়।

সুতরাং আজ আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা লেখাপড়া শিখে কি শুধুই চাকুরি করবো, না লেখাপড়ার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা করে সেই জ্ঞানের আলোকে নিজেই হাজার হাজার বেকারের জন্যে গড়ে তুলবো কর্মসংস্থান। অন্যদিকে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রেরও যে একটি বিরাট দায়িত্ব রয়েছে এবং স্বেচ্ছাচারী অর্থনীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ টাকার প্রভাব তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে সে ব্যাপারে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। অন্যথায়, আমাজের তরুণ প্রজন্মরা বিভ্রান্ত হতেই থাকবে।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫

Share