দিনাজপুর করেসপন্ডেন্ট :
দিনাজপুরে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসে (জুন) ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ আছে এক শিশু। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আব্দুল ওয়ারেস রোগটিকে অজ্ঞাত বললেও কীটনাশকের প্রভাবে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর কারণ হিসেবে তারা কীটনাশক মেশানো লিচুকে দায়ী করছে।
তাদের দাবি, মৃত শিশুদের পরিবারগুলো হতদরিদ্র। এ কারণে তারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে, তাদের শীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। লিচু বাগানের কীটনাশকের প্রভাব এবং বাগানে বিষ স্প্রে করার পর পড়ে থাকা ফাটা লিচু শিশুরা কুড়িয়ে খেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হয়।
আইইডিসিআরের পরিচালক মাহমুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে শিশুরা অসুস্থ হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ কীটনাশক। তাদের বাড়ি বা বাড়ির পাশের লিচুগাছ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, কীটনাশক দেওয়া লিচু খেয়ে শিশুরা অসুস্থ হয়।
আক্রান্ত শিশুদের সকলের রোগের লক্ষণ প্রায় একই। প্রচণ্ড খিঁচুনি ও কাঁপুনি দিয়ে আক্রান্তের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এমনটি জানায়। মৃত শিশুরা হল— বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের ধুলট দাসপাড়া গ্রামের গজেন চন্দ্র দাসের ছেলে ফুল কুমার (২), একই এলাকার সেনগ্রামের মো. আব্দুল হকের মেয়ে মোছাম্মাত শামিমা (৫), সনকা গ্রামের মো. আবু তালেবের ছেলে মো. মামুন (৫), সাদুল্ল্যাপাড়া গ্রামের মো. রবি চাঁনের ছেলে মো. স্বপন আলী (৫), কাহারোল উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের মো. জিয়ারুল ইসলামের মেয়ে মোছাম্মাত ইয়াসমীন (৪), চিরিরবন্দর উপজেলার ডগনবাড়ী গ্রামের মো. আমানুল হকের ছেলে মো. আবু সায়েম (৪), বিরল উপজেলার নুরপুর গ্রামের মো. আলমের মেয়ে মিনারা (২), পার্বতীপুর উপজেলার জুরাই গ্রামের জোবাইদুর রহমানের মেয়ে জেরিন (৫), সদর উপজেলার মাধবমাটি গ্রামের মো. আজিবর রহমানের ছেলে মো. সামিউল (২) ও একই এলাকার রুবেল হাসানের ছেলে মো. সাকিব (৩)।
এ রোগে আক্রান্ত কাহারোল উপজেলার পূর্ব সাদিপুর গ্রামের মো. খায়রুল ইসলামের মেয়ে মোছাম্মাত নিধি (৩) সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নিজ বাড়িতে রয়েছে।
ঘটনার পর আইইডিসিআর গবেষক দল দুই দফায় আক্রান্ত শিশুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবক ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে। এলাকার শিশুদের রক্তের নমুনা গ্রহণ, লিচু বাগান পরিদর্শন এবং লিচু সংগ্রহ করে। পরে গবেষক দলটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে।
বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের পূর্ব সাদুল্ল্যাপাড়া গ্রামের মৃত মো. স্বপন আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের বাড়িটি লিচু বাগানে বেষ্টিত। বাড়ির চারপাশে প্রায় ২০০ গাছের দুটি বাগান আছে। স্বপনের বাবা মো. রবি চাঁন বলেন, আমার ছেলে সারাদিন খেলাধুলা করেছে। সে অসুস্থ ছিল না। রাত ১০টার দিকে হঠাৎ প্রচণ্ড খিঁচুনি ও কাঁপুনি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে। এর পর শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সকালে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। রাতেই সে মারা যায়।
স্বপনের খেলার সাথী প্রতিবেশী গোলজার আলীর ছেলে মাসুদ বলে, আমরা সারাদিন লিচু বাগানে খেলা করেছি। বাগানের পড়ে থাকা লিচু কুড়িয়ে খেয়েছি। একই এলাকার ধুলট দাসপাড়া গ্রামের গজেন চন্দ্র দাস বলেন, আমার একমাত্র ছেলে ফুল কুমার। রাতে প্রচণ্ড খিঁচুনি ও কাঁপুনি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে। এর পর শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং জ্ঞান হারায়। সকালে দিনাজপুর সদরের অরবিন্দু শিশু হাসাপাতালে ভর্তি করি। সেখানে এক দিন থাকার পর বিকেলে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করি। সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর সে মারা যায়।
তিনি বলেন, আমি লিচু বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। কাজ শেষে ফেরার পথে সন্তানের জন্য কিছু লিচু নিয়ে আসি। লিচু বাগানে কাজ করার সময় বাগানের মালিক লিচুতে একটি বিষ স্প্রে করেন। ওই বিষের প্রচণ্ড গন্ধ। ব্যবহারের পর বাগান মালিক বিষের প্যাকেট ও বোতলগুলো লুকিয়ে রাখেন। অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে পুড়িয়ে ফেলেন।
অজ্ঞাত বিষ ব্যবহারের বিষয়ে বীরগঞ্জ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। সম্ভবত ভারত থেকে চোরাইপথে এ সব বিষ নিয়ে এসে ব্যবহার করা হয়। আমরা বিষয়টি জানান পর বাগান মালিক ও লিচু ব্যবসায়ীদের নিয়ে মতবিনিময় করেছি। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অচিরেই লিচু বাগান এলাকায় সভা-সমাবেশ করা হবে।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চলতি মাসের বিভিন্ন সময়ে অজ্ঞাত রোগ নিয়ে ১২ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১১ শিশু মারা গেছে। এক শিশুকে তার পরিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে নিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ওই ঘটনার পর সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একদল গবেষক দুই দফায় আক্রান্ত শিশুদের বাড়ি পরিদর্শন করে।
১১ শিশুর মৃত্যুর পর দিনাজপুর প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ এবং মিডিয়াকর্মীদের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দিনাজপুর জেলা প্রশাসক আহম্মদ শামীম আল রাজী বলেন, বিষয়টি তদন্তে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী অফিসারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আপডেট: বাংলাদেশ সময় : ১১ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, বুধবার ২৪ জুন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, ১১:৩৯ অপরাহ্ন
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম-এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur