বাতাসের সাথে আপন মনে দুলছে লাখো কৃষকের স্বপ্ন

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের আওতায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মাঠ জুড়ে বাতাসে দুলছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। চলতি মৌসুমে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে বোরো ধানের সোনালী শীষ হাজারো কৃষক পরিবারের চোখে মুখে স্বপ্ন বুনছে। সেচ প্রকল্পের মাঠে প্রান্তরে অবারিত সবুজ ফসলের মাঠ। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ। বাতাসের সাথে আপন মনে দুলছে লাখো কৃষকের স্বপ্ন। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, সবুজ বর্ণ থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। আর মাত্র কদিনের পরই কৃষকের উঠানে আছড়ে পড়বে সোনালী ধান। ভরে উঠবে ধানের গোলা। মুখে ফুঁটবে সোনালী হাসি। উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় বোর ধানের আবাদি জমিতে এখন সকল প্রকার ধান গাছ লালচে ( কলা পাকা ) রঙ ধরতে শুরু করেছে শীষ গুলো। বর্তমানে শেষ মুহূর্তে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।

সোনালি ধান কদিনের মধ্যে শুরু হবে ধান কাটার মহা উৎসব । মাঠে পরিশ্রমের ফলানো ফসল গোলায় তোলার স্বপ্ন কৃষাণ-কৃষাণীদের চোখে মুখে। এখন শ্রমিক ও হারবেষ্টার মেশিন নিয়ে মাঠে নামবে কৃষকেরা। এখন চলছে ধান কাটার প্রস্তুতি। বাজারে কামারের দোকান গুলোতে কাস্তে, বিন্দা, কেনার ধুম। এছাড়াও বাঁশের তৈরি (আঞ্চলিক ভাষায় ) পায়ছা, প্লাাস্টিকের বস্তা, থীর্পাল ক্রয় করছে কৃষকেরা, নির্মাণ করছে লেপেপুচে ধানের খলা। নতুন ধান উঠবে কৃষকের গোলায়। ধান ঘরে তোলার স্বপ্নে চাষিরা বিভোর। কৃষাণ-কৃষাণীরা গোলা, খলা, আঙ্গিনা পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। এখন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু ধান কাটা হচ্ছে। পুরোদমে ধান কাটা শুরু হতে আরো এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে।

তবে কৃষকের মাঝে এখন দুচিন্তার কারণ একটাই কারণ আর কদিন পর গড়াবে বৈশাখ। বৈশাখী ফসলকে বলা হয় রিক্সি ফসল। এ মাস আসলেই কৃষকদের মাঝে বয়ে বেড়ায় এক ধরনে আশংকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড় আর শিলা বৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক পরিবারগুলোকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

সরকারের কৃষি বান্ধব কর্মসূচি, উপজেলা কৃষি অফিসের ব্যাপক তৎপরতা, কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম, অনুকূল আবহাওয়া, সার, কীটনাশকসহ বাজারে কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ, সহনশীল দাম, সহজলভ্যতা ও সেচের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সরবরাহ এবং আবাদ উপযোগী পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এছাড়া, কৃষি অফিস থেকে কৃষকদেরকে বিনামূল্যে উন্নত মানের বীজ ও সার, কীটনাশক সহায়তা ও সুবিধা এবং কৃষি অফিসার নিজে মাঠকর্মীদের সাথে মাঠে গিয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষকদের।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নে বোরো আবাদ হয়েছে ৯৯৮৪ হেক্টর, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬৫৪৯৫ মেট্টিক টন ধান, ৪৩১৩০ মেট্রক টন চাল। চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে।

এ ফসলের উপর নির্ভর করে কৃষক পরিবারের সারা বছরের সন্তানের পড়া লেখা সহ যাবতীয় খরচ । যার দরুন এ ফসলের প্রতি কৃষকের অনেক মায়া কান্না থাকে । স্বপ্নের আশার থলি নিয়ে প্রতিদিন ধানের জমি দেখতে যায় উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার আদুরভিটি গ্রামের কৃষক আয়নাল হোসেন (৫৫)। ধান জমির খোঁজ খবর নিতে মাঠে যাওয়া আর কয় দিন পর লাগবে পাকবে বোর ধান,তা নিজ চোখে দেখে আসেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কৃষকরা তাদের ক্ষেতের ধান কাটার অপেক্ষায় রয়েছে। খুশিতে কৃষক পরিবারসহ ব্যবসায়ীরা। ক্ষেতের মধ্যে পোতা বাঁশের কঁঞ্চি ও গাছের ডালের উপর ফিঙ্গে, শালিক, দোয়েলসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বসে আছে। সুযোগ বুঝে ধান ক্ষেতের ক্ষতিকারক পোকা ওইসব পাখিরা খেয়ে ফেলছে। আবার অনেকে অধিক ধান পাওয়ার আশায় নিজ নিজ জমিতে রাসায়নিক ও জৈব সার প্রয়োগ করছে। কেউ আবার ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছে। তবে কখন নতুন ধান ঘরে তুলবে এ স্বপ্নে বিভোর ওইসব কৃষকরা। তাই প্রতিটি বাড়ি বাড়ি চলছে নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসবের প্রস্তুতি।

উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের মোঃ কামাল হোসেন (৫০) বলেন, গতবারের চেয়ে এবার ধান ভাল হয়েছে। আর কয়েকদিন পর কাটা শুরু করা যাবে। তিনি বলেন, ক্ষেতে রোগ-বালাই ও পোকা আক্রমণ করতে পারেনি। প্রকৃৃতি অনুকূলে থাকলে স্বপ্নের সোনালী ধান যথাসময়ে ঘরে তুলতে পারবো। আশা করি প্রতি একরে ৭০ মণ ধান হতে পারে যদি কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে না, আসে।

ছেংগারচর পৌরসভার ঠাকুর গ্রামের কৃষক মোঃ আবুল হোসেন বলেন, সেচ খরচ এবং শ্রমের অধিক মূল্য ও কৃষি শ্রমিকের কিছু সমস্যা থাকলেও অনুকূল আবহাওয়ায় সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত সার, কীটনাশক ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়ায় এ বছর বোরো ধান খুবই ভাল হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ধান ক্ষেতের পাশে দাঁড়ালে বুক জুড়িয়ে যায়। এ বছর তিন একর জমিতে আমন আবাদ করেছি। গত বছরের তুলনায় এবার অধিক ফলন হবে বলেও আশা করছেন তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফয়সাল মোহাম্মদ আলী বলেন, বাম্পার ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে আমরা মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরণের কাজ করে আসছি। কৃষকরা যাতে লাভবান হতে পারে এবং কোন প্রকার সমস্যায় না পড়েন এ জন্য আমরা সার্বক্ষণিক নজর রাখছি। আশা করি বিগত মৌসুমের মতো এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে। এতে কৃষক অনেকটা লাভবান হবে বলেও আশা করছেন তিনি।

মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের মাঠ জুড়ে দুলছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। প্রাাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কৃষক এবার হাসিমুখেই তাদের ধান গোলায় তুলতে পারবেন। আমরা কৃষকদের সেই হাসির ঝিলিক দেখতে চাই। কৃষকদের বারো আবাদের চাষে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন সময় কৃষকদের প্রক্ষিণ ও সরকারিভাবে প্রণোদণা দেয়া হয়েছে। অল্প খরচে অধিক ফলন যাতে কৃষকরা করতে পারেন এজন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা উদ্বুদ্ধ করেছেন। কৃষকদের আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হিসেবে গড়ে তুলতে কৃষি বিভাগ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে অন্য দেশের সাথে পাল্লাা দিয়ে বাড়ছে উৎপাদন।

নিজস্ব প্রতিবেদক, ১০ এপ্রিল ২০২৫

Share