অটিজম হচ্ছে শিশুর মস্তিষ্কের স্নায়বিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা। শিশুর জন্মের প্রথম এক থেকে তিন বছরের মধ্যেই এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। অটিজম এর প্রকৃত কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। তাই এর নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়নি বলে জানিয়েছেন নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রফেসর ডা.বাসনা মুহুরী।
তিনি বলেন,‘শুধু যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আচরণ, যোগাযোগ ও ব্যবহারগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নিবিড় পরিচর্যা করে অটিজমদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। যদি তাড়াতাড়ি ডায়াগনোসিস করে এবং বিশেষায়িত স্কুলের মাধ্যমে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় তবে তাদের আচরণগত উন্নতির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও পরিলক্ষিত হয়।’
এ চিকিৎসক বলেন,‘সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসকের মাধ্যমে অটিজম শনাক্তের পর তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তবে বিশেষ স্কুল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ।’
শুক্রবার ১ এপ্রিল বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রফেসর ডা.বাসনা মুহুরী। ১৫তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
তিনি বলেন,‘ সমাজ সেবা অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রায় ১৪ হাজার মতো অটিজম আক্রান্ত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা চার-পাঁচ গুণ বেশি হবে।’
ডা. বাসনা মুহরী জানান,এক সময় অটিজম ছিল একটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যু। এ সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা ও স্কুল সাইকোলজিস্ট সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন,‘ আমাদের সমাজে অনেক ব্যক্তি বা পরিবার রয়েছে যাদের অটিজমে আক্রান্ত শিশু রয়েছে। এ শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ। প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও সুযোগ পেলে তারাই পরিণত হবে সম্পদে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অটিজমকে অনেকেই রোগ বলে অভিহিত করেন। অনেকেই এখনও অটিস্টিক শিশু দেখলে তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে থাকেন, তাদের বাবা-মাকে নানাভাবে কুসংস্কারের বলি করা হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এটা প্রকট। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বর্তমানে অটিজম নিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সবার মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। সচেতনতা বাড়াতে সবাইকে কাজ করতে হবে ।’
সংবাদ সম্মেলনে এ চিকিৎসক বলেন,‘ সম্প্রতি প্রকাশিত সমীক্ষা মতে প্রতি ৪৪ জনে একজন অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু রয়েছে। ইউ এস সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী প্রতি ৫৪ জন আমেরিকান শিশুর মধ্যে একজনের অটিজম আছে। গবেষণায় আরও জানা গেছে যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিজম হয়ে থাকে ৪-৫ গুণ বেশি। অটিজমের বিস্তার বার্ষিক ১০-১৭ % বেড়েছে। এ বৃদ্ধির নির্ভরযোগ্য কোনো কারণ ও ব্যাখ্যা জানা যায়নি। তবে উন্নত যথাযথ রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়ার অভাব এবং পরিবেশগত প্রভাবের জন্য দায়ী বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন,‘ বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে অটিজম বিষয়ক ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সামগ্রিকভাবে প্রতিটি বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। তবে চট্টগ্রামে থেরাপিস্ট এবং বিশেষায়িত স্কুলের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং পেশা হিসেবে যথাযথ সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রীরা এ বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিও হচ্ছে না।’
নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ বলেন,‘ সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শিশু মনোবিকাশকেন্দ্র চালু পূর্বক দ্রুত অটিজম শনাক্ত করার ব্যবস্থা চাই। চট্টগ্রামে যেসব স্কুল রয়েছে গত কয়েক বছর ধরে প্রশিক্ষণ সচেতনতা সৃষ্টি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি অটিজম শিশুর আচরণ স্বতন্ত্র হওয়ার কারণে তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা (IEP মাধ্যমে) ভিন্ন। তাই ১:১ বা ক্ষেত্র বিশেষে ১:২ ব্যবস্থায় দ্রুত অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সামগ্রিক এ বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।’
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা অভিভাবকরা অন্যান্য স্বাভাবিক সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি অটিজম শিশুর জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনে অক্ষমতার কারণে এবং পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় যথাযথভাবে স্কুলগুলো পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে স্কুল পরিচালনা সহজ হতো। তবে আশার কথা হলো ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন টাস্কফোর্স গঠন পূর্বক প্রায় কয়েক বছর যাবত অটিজম শিশুদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
তিনি বলেন,‘ সবাই যদি অটিজম শিশুদের স্বাভাবিক শিশুর মতো গ্রহণ করে এবং তাদের কল্যাণে এগিয়ে আসে তাহলেই বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালনের সফলতা আসবে।’
এ সময় নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আট দফা দাবি জানানো হয়।
শনিবার সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও পালন হবে ১৫ তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—‘এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি’।
এ উপলক্ষে শনিবার নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন নগরের থিয়েটার ইন্সটিটিউটে অটিজম শিশুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,অটিজম উত্তরণে আলোকিত মা সম্মাননা প্রদান এবং দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
২ এপ্রিল ২০২২,
এজি