মিয়ানমারে মংডু থানাধীন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান এখনো অব্যাহত রেখেছে বর্মী বাহিনী।
জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদির ইয়াংগুন সফরের পর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কৌশল পরিবর্তন করেছে। রোগের প্রতিষেধক টিকার নামে বাধ্যতামূলক বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করা এক দিনেই চারটি শিশুর মৃত্যু ও আরো বহু শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তাই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চলমান পৈশাচিকতায় টিকতে না পেরে স্বদেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের স্রোত থামছে না।
এদিকে টেকনাফের বিজিবি রোববার রাতে ও গতকাল সোমবার ৩৭টি নৌকায় আসা ভাগ্যবিড়ম্বিত চার শতাধিক নারী-শিশুকে আটক করে স্বদেশে ফেরতের পাঠিয়েছে। এই স্বদেশে ফেরতের সময় এক রোহিঙ্গা নারী পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন।
তারা রোববার ভোরে নাফনদী হয়ে প্রবেশ করে টেকনাফের হ্নীলায় পাহাড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দাবি, বর্মীবাহিনীর ত্রিমুখী নৃশংসতা-বর্বরতার খবর বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না মিয়ানমার সরকার। সেনা তাণ্ডবের খবর পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় বর্মী বাহিনী আরকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কৌশল পরিবর্তন করেছে। তবে নির্যাতন বন্ধ করেনি।
গত সপ্তাহ থেকে নির্যাতনের কৌশল পরির্বতন করে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি, দোকানপাটসহ বিভিন্ন ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে। নির্দেশ অমান্যকারীকে প্রাণে মারার হুমকিও দিচ্ছে। পুরুষদের গণহারে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলা ও শিশুদের রোগের প্রতিষেধক টিকার নামে বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করার অভিযোগ করেছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।
মংডুর আশপাশের গ্রামে বর্মীবাহিনী রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিতে মাইকিং করে নির্দেশ দিচ্ছে। নির্দেশ অমান্যকারীকে মোটা অঙ্কের জরিমানারও হুমকি দিচ্ছে।
গত রোববার মংডুর নেমইনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জোরপূর্বক টিকা দিয়ে ইয়াসিন জোহার, বদি আলম, গুরা মিয়া ও রাবিয়া খাতুন নামে চার শিশুকে হত্যা করে। একই দিনে বিকেলে জানাজার পর স্থানীয় কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
অন্য দিকে জান্নাত আরা বেগম, শফি আলম, নজিব উল্লাহ, কামাল হোসেনসহ অসংখ্য শিশুকে জোরপূর্বক টিকা দেয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদেরকে মংডুর সাহাব বাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
অন্য দিকে বুচিদং থানাধীন আশপাশ রোহিঙ্গাদের গ্রামেও এই টিকা দেয়ার নির্দেশ জারি করেছে সেনাবাহিনী। সেখানে আতঙ্ক আরো বেড়েছে। তাই বিজিবির সতর্ক নজরদারিতেও থামছে না রোহিঙ্গাদের প্রবেশ।
রোববার ভোরে আরো ৭৩ পরিবারের চার শতাধিক নারী ও শিশু রোহিঙ্গা টেকনাফের হ্নীলায় পাহাড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেন। সমভ্রম ও স্বজনহারা বিধবা রোহিঙ্গা নারী ও পিতৃহারা শিশুদের কান্নায় এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড শীতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গারা।
এমন সময় টেকনাফের উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি ও হ্নীলা ইউপি যৌথ অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের আটক করে। আটক রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ফেরত পাঠানোর সময় মিয়ানমারের বুড়া সিকদারপাড়ার আবুল আলমের স্ত্রী খুরশিদার প্রসব বেদনা শুরু হয়।
তাকে দ্রুত পার্শ্ববর্তী হোছন আহমদের ভাড়া বাসার একটি কক্ষে নিয়ে গেলে একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তান প্রসব করেন। বিজিবি জওয়ানরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে প্রসূতিকে উন্নত চিকিৎসা সহায়তার জন্য হাসপাতালে পাঠান।
গত রোববার ভোর রাত হতে হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালী, নাটমোরাপাড়া, জালিয়াপাড়া, পূর্ব ফুলের ডেইল, হোয়াব্রাং সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা উপজেলার হ্নীলা বাসস্টেশনের উত্তর পাশের খোলা মাঠে রোহিঙ্গারা জড়ো হয়েছেন সংবাদ পেয়ে বেলা ১১টার দিকে হ্নীলা বিওপি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার নজরুল ইসলাম বিশেষ টহল দল নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পরিস্থিতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ শফিউল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এ সময় প্রশাসনের তৎপরতা দেখে কৌশলে রোহিঙ্গা পুরুষরা পালিয়ে গেলেও নারী-শিশুরা রয়ে যায়।
টেকনাফ বিজিবির ২ নং ব্যাটালিয়ানের উপ-অধিনায়ক আবু রাসেল সিদ্দিকী জানান, মিয়ানমার থেকে রোববার ভোর থেকে প্রবেশ করে রোহিঙ্গারা হ্নীলায় বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছিলেন। এই খবর পেয়ে তাদের আটক করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, এরা সর্বমোট ৭৩টি পরিবারের সদস্য এবং মিয়ানমারের চারটি গ্রামের বাসিন্দা।
রয়ে যাওয়া নারী ও শিশুকে ৩৭টি নৌকায় করে নাফনদীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। এ ছাড়া উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোববার ৩৩ জন প্রবেশের সময় আটক হয়েছিলেন। তাদেরও স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি।
এদের রোববার সন্ধ্যা এবং গতকাল সোমবার ভোরে নৌকায় করে ফেরত পাঠানো হয়। অন্য দিকে, উখিয়ার পাশের উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ৩৩ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। এর মধ্যে ১৪ জন পুরুষ, ১১ নারী ও আটটি শিশু রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ অক্টোবর থেকে রাখাইনদের হিসাবে কমপক্ষে সাড়ে তিন শ’ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। ‘সেনাবাহিনী বিভিন্ন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল। লোকজনকে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়।
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলিবর্ষণ করে তাদের হত্যা করে।
রোহিঙ্গারা যে যে ভাবে পেরেছে লুকাতে ও পালিয়ে যাওয়ার সময় পথে-ঘাটে, খালে নদীতে তাদের মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করা হয়।
রোহিঙ্গারা নাফনদী হয়ে নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে তাদের নৌকার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়।
এ পর্যন্ত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাস্তুহারা হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি উগ্রপন্থী মগেরাও রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে লুটপাট চালাছে।
গৃহহারা দেশছাড়া রোহিঙ্গারা চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ধর্ষিতা ও আহতরা পাচ্ছেন না চিকিৎসা ও ওষুধ। বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলো। ঘরপোড়া আশ্রয়হীন নারী-শিশুরা খোলা আকাশের নিচে কোনোমতে জীবনধারণ করে আছে।
আর রাতের অন্ধকারে শিশুদের কোলে নিয়ে মায়েরা লুকিয়ে থাকছেন জঙ্গলে। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরকানে এখনো বিপদসঙ্কুল অবস্থা বিরাজ করছে।
নিউজ ডেস্ক ।। আপডটে,বাংলাদশে সময় ৫ : ০৪ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ মঙ্গলবার
ডিএইচ