বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তা থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে বিশ্ব

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে প্রশংসার দাবিদার হয়েছে এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও দেশগুলো এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহযোগিতার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটি এখন বাংলাদেশের জন্য বড় রকমের বোঝা হয়ে উঠেছে।

দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তা থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে বিশ্ব। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের আগমনের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে যেভাবে আর্থিক অনুদান আসছিল এখন সেভাবে আসছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে অনুদান এসেছে মাত্র ১১০ কোটি টাকা। অনেক সংস্থা এখন আর রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো প্রকার অনুদান দিতেই রাজি না। একদিকে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে অন্যদিকে অনুদান কমে যাচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ছে বাংলাদেশ সরকারের ওপর।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উচিত অনুদান চাওয়ার ওপর জোর দেওয়ার চেয়ে এখন এদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালানো। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামনে অনুদানের পরিমাণ আরও কমবে। সুতরাং যতদিন এরা বাংলাদেশে থাকবে ততদিন এদের থাকা-খাওয়ার ভার বাংলাদেশকেই নিতে হবে। তারা বলছেন, এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি হলো এদের জন্য অর্থ সহায়তা বাড়ানো।

যেসব দেশ এবং সংস্থা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সরকারের প্রশংসা করেছে এবং যেসব আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

তারা বলেন, যেভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভরণপোষণ দিতেই সংকটে পড়বে। আর ঠিকমতো ভরণপোষণ না দিতে পারলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। কক্সবাজার ও পার্বত্য এলাকাসহ আশপাশের জেলাগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।

এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর মিয়ানমার সামরিক জান্তার নির্যাতনের মুখে দেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। ওই সময় প্রাথমিক সহায়তার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসে। ওই অর্থবছরে দেশে এনজিও খাতে বিদেশি অর্থায়নও বেড়ে যায়।

ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, এনজিও খাতে রোহিঙ্গাদের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকার অনুদান এসেছে। পরের অর্থবছরে তা কমে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে রোহিঙ্গাদের জন্য এনজিও খাতে বিদেশি অনুদান এসেছে ৮০৫ কোটি টাকা। সবশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১১০ কোটি টাকার অনুদান এসেছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সময় যত যাবে অনুদান তত কমবে। কারণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মানুষ একজনকে অধিক দান করার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখানে বাংলাদেশেরও কিছু করার নেই। এটা বিশ্ব রাজনীতির বিষয়। কিন্তু তারা কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না। কারণ হলো রোহিঙ্গারা তো আর তাদের ঘাড়ের ওপর পড়েনি। গতকাল জাতিসংঘে একটা রেজুলেশন হলো সেখানে ভারত, জাপান ভোট দিল না। চীন, রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে। এখন এটা কীভাবে এত দ্রুত সম্ভব হবে? আর যে রেজুলেশন পাস হয়েছে তাতে লাভও বা কী? সুতরাং অনুদানের চেয়ে সরকারের উচিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের এ বিষয়ে সমর্থন নেওয়া।

রোহিঙ্গাদের শুরু থেকে অনুদান দিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংক। গত ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক ও কেএফডব্লিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় ‘জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মাল্টি-সেক্টর’ প্রকল্পের প্রথম সংশোধন জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়।

সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘(একনেক টেবিলে প্রকল্পটি ওঠার আগে) বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা টেবিলে আমি কথা বলেছি। তারা আমাদের অনুদান দিতে চায়নি। তারা বলেছে, বাংলাদেশ আর কোনোভাবেই অনুদান পাবে না। যেহেতু আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তারা ঋণ দেবে আমাদের। আমরা বলেছি, তাহলে আপনাদের সঙ্গে আমাদের এটা শেষ সভা আর কোনো সভা করব না। যদি অনুদান নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে আমরা এটা গ্রহণ করব। ’

সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (এসকেইউএস) নামে একটি এনজিও কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ক্রমেই রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি অনুদান কমে আসছে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক দাতা ক্যাম্প এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। একই সঙ্গে তারা কার্যক্রমও বন্ধ করেছে। অনেকে আবার করোনার কারণে অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।

কোনো গোষ্ঠী যখন শরণার্থী হয় তখন মানবিক কারণে সবাই তাদের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের এ সংকট যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন মানুষের মধ্যে একপ্রকার অতিষ্ঠভাব চলে আসে। বিশ্বের সব দেশের শরণার্থীদের ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। এর মধ্যে আবার বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলানোর আগেই দ্বিতীয় ধাক্কা আঘাত হেনেছে। আগামীর অর্থনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে বিষয়ে এখনো অন্ধকারে অর্থনীতিবিদরা। মহামারীর মধ্যেও থেমে নেই যুদ্ধ। নতুন করে শরণার্থী হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ।

এ অবস্থায় আগামীতে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ আরও কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনকি দ্রুত এদের প্রত্যাবাসন করতে না পারলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ক্ষোভ আরও তীব্রতর হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। এছাড়া আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে গিয়ে রোহিঙ্গারা অপরাধ কর্মকাণ্ডে আরও জড়িয়ে পড়বে বলেও মনে করছেন তারা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যখন কোনো জনগোষ্ঠী শরণার্থী হয় তখন মানবিক কারণে খুব বেশি রেসপন্স থাকে। অনেকেই তখন সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু এদের অবস্থান যত দীর্ঘ হয় দাতাদের ক্লান্তি এসে পড়ে। এ বিষয়টি আমি সরকারকে শুরুর দিকেই বলেছিলাম। বাস্তবে তাই হচ্ছে। অনুদানের পরিমাণ কমলেও তেমন একটা অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যেহেতু তাদের আশ্রয় দিয়েছে সুতরাং যেভাবেই হোক এদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর সঙ্গে চেষ্টা করা হবে কীভাবে অনুদান আনা যায়। এতে হয়তো বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যার ফলে সরকারের কিছু চাপ বাড়বে। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে খুব বেশি চাপ পড়বে না। এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, অতীতেও কিন্তু বেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল। তাদেরও কিন্তু বাংলাদেশকেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ’

অনেকে মনে করছেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বসিয়ে না রেখে তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় কি না? বিশেষ করে ভাসানচরে বা টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কুটির শিল্পের আওতায় সক্ষম রোহিঙ্গাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় কি না? এতে করে বাংলাদেশ সরকারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কিছুটা হলেও কমবে।

তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতে করে সংকট আরও বাড়বে। রোহিঙ্গাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে গেলে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ওপর চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক অনুদান আরও কমে যাবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থান হারাতে পারে। সব মিলে দেশের মধ্যে আরেকটি অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে রোহিঙ্গারা যদি বাংলাদেশে আরও দীর্ঘদিন থাকে তাহলে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, রোহিঙ্গারা এ দেশে আসার পর থেকেই নানান অপরাধে লিপ্ত। দিন যত যাবে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে তাদের এ অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়বে। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির পাশাপাশি বিদেশে দেশের সুনামও ক্ষুন্ন হবে।

এ বিষয়ে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘তারা অনেক কুকামও করে। আমি উপদেষ্টা থাকার সময় মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শুনলাম বাঙালিরা সেখানে অনেক ঝামেলা পাকায়। খোঁজ নিয়ে দেখলাম এরা সব রোহিঙ্গা। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এরা বিদেশি গিয়ে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছে। এই প্রবণতা এখনো আছে। আবার ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততার কথা তো সবার জানা। সুতরাং সরকারকে এদের বসিয়ে বসিয়েই খাওয়াতে হবে। আর চেষ্টা করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফেরত পাঠানো যায়। ’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালি উর রহমান বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দাতাদের চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক টিম গঠন করে প্রত্যাবাসনকে বেগবান করতে হবে। এটা বড় সমস্যা। যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা করার কথা বলেছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ’ (দেশ রুপান্তর)

বার্তা কক্ষ, ২১ নভেম্বর ২০২০

Share