ইসলাম ডেস্ক :
সিয়াম শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। তাইতো চুপ বা নিস্তব্ধ থাকাকে সিয়াম বলে। আর যে ব্যক্তি চুপ থাকে তাকে সায়েম বলে। আল্লাহ তায়ালা হযরত মরিয়ম আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘটনা তুলে ধরে বর্ণনা করেন, ফাইম্মা তারাইন্না মিনাল বাশারি আহাদান ফাকুলি ইন্নি নাজারতু লির রাহমানি সাওমান ফালান উকাল্লিমাল ইয়াওমা ইনসিয়ান।
অর্থ : (সন্তান ভূমিষ্ঠের পর) যদি মানুষের মধ্যে কাউকে তুমি দেখ (কোনো প্রশ্ন বা কৈফিয়ত করতে) তবে তুমি বলো, ‘আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশে সাওম বা রোজা (কথা বলা থেকে বিরত থাকতে) মানত করছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলবো না। (সুরা মারইয়াম : আয়াত ২৬)
[কোরআন কারিমের এ আয়াতের শিক্ষনীয় ঘটনা : হযরত মরিয়ম আলাইহি ওয়া সাল্লামের গর্ভে সন্তান জন্ম লাভের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, শিশুর ব্যাপারে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তার জন্মের ব্যাপারে যে কেউ আপত্তি তুলবে তার জবাব দেবার দায়িত্ব এখন আমার (আল্লাহর)। উল্লেখ্য, বনি ইসরাঈলের মধ্যে মৌনতা বা কথা বলা থেকে বিরত থাকার পদ্ধতি অবলম্বনের রোজা রাখার রীতি ছিল।]
বলা বাহুল্য এখানে ‘সওম’ এর অর্থ হলো কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
শরিয়তের পরিভাষায় সাওম বা সিয়াম হলো- ফজর তথা সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী-সঙ্গম, অশ্লীলতা ও অসার ফাহেশা কথা-বার্তাসহ ইত্যাদি যাবতীয় রোযা নষ্টকারী কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর বন্দেগি করা।
কারণ প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়; বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই হলো (প্রকৃত) সিয়াম। সুতরাং যদি তোমাকে কেউ গালাগালি করে অথবা তোমার প্রতি মুর্খতা দেখায়, তাহলে তুমি (তার প্রতিকার বা প্রতিশোধ না নিয়ে) তাকে বলো যে, আমি সায়েম, আমি রোযা রেখেছি, আমি রোযা রেখেছি। (মুস্তাদরেকে হাকেম, ইবনে হিব্বান, সহিহুল জামেইস সাগির)
পূর্ববর্তী ধর্মে সিয়াম বা রোজা
মানুষের জন্য রমজান মাসের সিয়াম বা রোজাই প্রথম রোজা নয়। কারণ, সিয়াম বা রোজা হলো এমন এক ইবাদত, যা মানুষ সৃষ্টির পর থেকেই আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য ফরজ করেছেন। যা আমরা কুরআনুল কারিমে পাই।
আল্লাহ বলেন, ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন ক্বাবলিকুম লাআল্লাকুম তাত্তাকুন। (সুরা বাক্বারাহ : আয়াত ১৮৩) অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূববর্তী উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার।
এ থেকে বোঝা যায়, পূর্ববর্তী সকল উম্মতের জন্য রোজা ফরজ ছিল। ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জিনিস তেকে বিরত থেকে রজিা পালন করতেন। তাওরাত ও ইঞ্জিলের বর্তমান সংস্কারগুলো থেকেও জানা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা রোজাকে পূর্ববর্তী বান্দাদের ওপর ফরজ করেছিলেন।
হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগম করলেন, তখন দেখলেন, মদিনার ইয়াহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তখন তিনি তাদের জিজ্ঞাস কররেন, ‘এটা কি এমন দিন যে, তোমরা রোজা রাখছ?’ ইয়াহুদিরা বললো, ‘এ এক মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার কাওমকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন এবং ফিরাউন ও তার কাওমকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। তাই মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যেই এই দিনে রোজা পালন করেছিলেন। আর তাইতো আমরাও এ দিনে রোজা পালন করি।
এ কথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘মুসার স্মৃতি পালন করার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে আমরা অধিক হকদার।’ সুতরাং তিনি ওই দিনে রোজা রাখলেন এবং সবাইকে রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।
আমরা কেন রোজা রাখবো?
মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার ওপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পর্যাযে আদেশ-নিষেধ, উপদেশ-ইতিহাস আরোপ করেছে। তার মধ্যে বহু বিষয়কেই পর্যায়ক্রমে ফরজ তথা আবশ্যকীয় এবং হারাম তথা বর্জনীয় করেছেন। অনুরূপ একটি ফরজ হচ্ছে রমজান মাসের সিয়াম বা রোজা। যা তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু করে ফরজ করেছেন।
প্রথম ধাপ :
প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোজা পালন করতেন। আর এ দেখে সাহাবায়ে কেরামগণও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে রোজা পালন করতেন। যাতে রোজা পালনের অভ্যাস তৈরি হয়।
দ্বিতীয় ধাপ :
কুরাইশরা জাহেলি যুগে আশুরার রোজা রাখ। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসে হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণে তার স্মৃতি পালনে আশুরার দিনে গুরুত্বের সঙ্গে নিজেও সিয়াম বা রোজা রাখলেন এবং তার সঙ্গীগণকেও এ রোজা রাখার তাগিদ দিয়েছেন। তখন এ রোজা ফরজ ছিল।
তৃতীয় ধাপ :
অতঃপর সিয়াম বা রোজার বিধান নিয়ে কোরআনুল কারিমের আয়াত অবতীর্ণ হলো। কিন্তু শুরুতে তখনো রোজা পূর্ণ আকারে ফরজ ছিল না। যার ইচ্ছা সে রোজা রাখতো এবং যার ইচ্ছা সে না রেখে মিসকিনকে খাদ্য দান করতো। কিন্তু রোজা রাখাটা আল্লাহর দরবারে পছন্দনীয় ছিল।
এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, যারা রোজা রাখার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রাখতে চায় না, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সঙ্গে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি তোমরা রোজা রাখো, তাহলে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর; যদি তোমরা উপলব্ধি করতে পার। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৪)
চতুর্থ ধাপ :
দ্বিতীয় হিজরির শা’বান মাসের দ্বিতীয় তারিখ সোমবার প্রত্যেক সামর্থবান প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের পক্ষে পূর্ণ রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, গাহরু রামাজানাল্লাজি উনজিলা ফিহিল কুরআনু হুদালিন্নাসি ওয়া বায়্যিনাতিম মিনাল হুদা ওয়াল ফুরকানে; ফামান শাহেদা মিনকুমুশ শাহরা ফালইয়াসুমহু। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। অর্থ- রমজান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোজা রাখে।
অতএব সামর্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্ক (জ্ঞানসম্পন্ন সাবালক) গৃহবাসীর জন্য মিসকিনকে খাদ্যদানের বিদান রহিত হয়ে গেল এবং বৃদ্ধ ও চিররোগীর জন্য তা বহাল রাখা হলো। কিছু কিছু আলেমগণের মতে এ বিধান গর্ভবর্তী ও দুগ্ধদাত্রী নারীদের জন্যও বহাল করা হলো; যারা গর্ভকালে বা দুগ্ধদান কারে রোজা রাখলে তাদের সন্তানের বিশেষ ক্ষতি হবে আশঙ্কা থাকে।
সুতরাং রোজা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য আবশ্যকীয় বিধান বিধায় আমরা রমজান মাসের রোজা পালন করবো। ইনশাআল্লাহ।
তথ্য সূত্র : (কুরআনুল কারীম, তাফহিম, সহিহ বুখারি, মুসলিম, মুস্তাদরেকে হাকেম, ইবনে হিব্বান, জামিউস সাগির)
পরবর্তী লেখা : তারাবিহ নামাজের বিধান
চাঁদপুর টাইমস ডটকমের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কোরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন