প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া ‘সুইসড্রাম ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট কোম্পানি’র পরিচালক কাজী আল-আমিনসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪। প্রতারক চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জৌলুসপূর্ণ ও আকর্ষণীয় রেস্টুরেন্টে ভিকটিমদের নিয়ে প্রতারণামূলক সভা, সেমিনার, মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ, আকর্ষণীয় লাঞ্চ ও ডিনার পার্টির আয়োজন করতো। অসহায়, নিরীহ অর্ধশিক্ষিত এমনকি শিক্ষিত শ্রেণির ভিকটিমরা এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে প্রলুব্ধ হয়ে খুব সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিতেন এবং নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে চক্রটি বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতো।
র্যাব জানায়, চক্রটি এস-ফ্যাক্টর (S-Factor) নামে একটি ওষুধ (সর্ব রোগের মহৌষধ) যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ওষুধ বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। এমনকি এই ওষুধ করোনা প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে বলেও প্রচার করে তারা।
২২ সেপ্টেম্বর বুধবার র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক এসব তথ্য জানান। এ চক্রের প্রতারণার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।
গ্রেফতাররা হলো- সুইসড্রাম কোম্পানির পরিচালক কাজী আলামিন (৩৪), মো. সালাউদ্দিন (৪৬), শেখ মো. আব্দুল্লাহ (৫৯), মনিরা ইয়াসমিন (৪৩), মো. জাহিদ হাসান (৪২), মো. স্বপন মিয়া (৩৮), মো. শাহজাহান (২৫), মো. মিজানুর রহমান (৫০), মো. বাদশা ওরফে সুলাইমান (২৬), ইমাম হোসাইন (৩৫), মো. আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আনারুল ইসলাম (৪২), মিজানুর রহমান (৩৯), মো. ফারুক উদ্দিন (৪৭), আঞ্জমান আরা বেগম (৫২), শেখ রবিন (৩৩), ইমাম হোসাইন (৩৫) ও মোছা. আছমা বেগম (৩৫)।
অভিযানে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি ল্যাপটপ, একটি প্রজেক্টর, দুটি সিল, দুটি ব্যানার, চারটি ডায়েরি ও খাতা, একটি রেজিস্টার, কোম্পানির ১২৫টি লিফলেট, প্রতারণায় ব্যবহৃত সুইসড্রাম কোম্পানির ভুয়া ওষুধ ও প্রসাধনী সামগ্রী, সুইসড্রাম কোম্পানির ২৫ সেট ডিস্ট্রিবিউটর ওয়ার্কিং ফাইল, ২৩টি মোবাইল ফোন ও নগদ এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৫ টাকা জব্দ করা হয়।
প্রতারক চক্রের প্রতিটি সদস্য প্রতারণাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় তাদের একটি সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। এই প্রতারক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ও সদস্য রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার ও অসচ্ছল যুবক-যুবতী এমনকি শিক্ষিত লোকজনকে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার ও সাধারণ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। নিয়মিত গমনাগমনকারী ও কথাবার্তায় পটু, আর্থিকভাবে সচ্ছলদের সদস্য সংগ্রহের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। এরপরই তাদের মোটা অংকের টাকা প্রদানে বাধ্য করে ও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
চক্রের হোতা সুইসড্রাম কোম্পানির পরিচালক কাজী আল আমিন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে কোম্পানির নতুন সদস্যদের কাছে প্রবাসী ও বিভিন্ন দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। তাদের প্রলুব্ধ করে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে মনোনয়ন প্রদান করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। ভিকটিমদের প্রলুব্ধ করে ও তথ্য সংগ্রহ করে ভুলিয়ে নানা কৌশলে প্রতারক চক্রের অফিস কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হতো। এরপর তাদের প্রতি গ্রাহক অথবা টার্গেট পূরণের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা পারসেন্টেজ দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করা হতো ও অধিক মুনাফা লাভের স্বপ্ন দেখানো হতো।
সভা-সেমিনার, মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ, আকর্ষণীয় লাঞ্চ ও বুফে ডিনার পার্টির আয়োজনে প্রতারণার কৌশল
প্রতারক চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জৌলুসপূর্ণ ও আকর্ষণীয় রেস্টুরেন্টে ভিকটিমদের নিয়ে এসে প্রতারণামূলক সভা, সেমিনার, মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ, আকর্ষণীয় লাঞ্চ ও ডিনার পার্টির আয়োজন করতো। অসহায়, নিরীহ অর্ধশিক্ষিত এমনকি শিক্ষিত শ্রেণির ভিকটিমরা এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে প্রলুব্ধ হয়ে খুব সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিতেন।
গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সুইসড্রাম কোম্পানি মধ্যশিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবক ও শিক্ষিত সরল শ্রেণির লোকজনদের মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে ও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সদস্য হিসেবে সুইসড্রাম অ্যাপস-এ অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। প্রতারণার কৌশল হিসেবে তারা ঘন ঘন তাদের অফিস পরিবর্তন করতো। প্রতারক চক্রটি সুইসড্রাম কোম্পানির এস-ফ্যাক্টর (S-Factor) নামে একটি ওষুধ (সর্বরোগের মহৌষধ), যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ওষুধ বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। এমনকি এ ওষুধ করোনা প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে বলেও প্রচার চালায় তারা।
সুইসড্রাম কোম্পানিতে নতুন সদস্যদের ৫টি ক্যাটাগরির মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। ১ ও ২ ক্যাটাগরিতে চার হাজার ২০০ থেকে ছয় হাজার ২০০ টাকার বিনিময়ে একটি প্যাকেট ওষুধ ও ৩, ৪ নম্বর ক্যাটাগরিতে ২৬ হাজার ২০০ থেকে ৫৮ হাজার টাকার বিনিময়ে ৬-১৪ প্যাকেট ওষুধ ও ৫ নম্বর ক্যাটাগরিতে এক লাখ ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ২৮ প্যাকেট ভুয়া ওষুধ প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করে আসছিল। প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি তাদের নির্দিষ্ট কোনো সাইনবোর্ড ও ঠিকানা ব্যবহার করতো না।
> তাদের কোনো পণ্যের বিএসটিআই অনুমোদিত নয়।
> ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত নয়।
> পণ্য আমদানি সংক্রান্তে তাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।
> পণ্য সম্পর্কে কোনো নোটিফিকেশন কিংবা ডিক্লারেশন নেই।
> কোম্পানি কর্তৃক সরকারি ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদান করা হয় না।
অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, কোম্পানিটি সম্পূর্ণভাবে প্রতারণার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে। নিরীহ, অসহায়, সরল ব্যক্তিদের স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন ও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক পার্সেন্টেজ অর্জনের প্রলোভন দেখানো হতো। সুইসড্রাম কোম্পানি তাদের প্রচারিত ওষুধ এস-ফ্যাক্টর (S-Factor) (সর্ব রোগের মহৌষধ) ও সৌন্দর্যবর্ধণকারী প্রসাধনী সামগ্রী উচ্চমূল্যে বিক্রি করে যা শরীর ও ত্বকের ব্যবহারের প্রেক্ষিতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর এমনকি ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগের সৃষ্টি করে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৪ অভিযানটি পরিচালনা করে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।