হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ভ্রমণ : যাওয়ার উপায়

অরণ্য ভ্রমণ মানে প্রকৃতির শান্ত প্রাণের এক স্নিগ্ধ পুনরুজ্জীবনের আলিঙ্গন। সবুজের ভিড়ে হারানোর সময় সঙ্গী হয় পাতার শব্দ আর পাখির কিচির-মিচির। বনের যত গহীনে যাওয়া যায় ততই প্রবল হতে থাকে বিস্ময়কর কিছু খুঁজে পাওয়ার আকর্ষণ। কখনো তা দুর্লভ প্রজাতির কোনও গাছ বা অদ্ভূত কোনও বন্যপ্রাণী। কখনও তা হতে পারে কোনও এক আদিবাসী শিশুর স্তম্ভিত চাহনী। বিশেষ করে বাংলাদেশের পাহাড়ি বনগুলোতে এ সবকিছুরই দেখা মেলে। তন্মধ্যে জঙ্গলেই মঙ্গল সন্ধানীদের জন্য প্রিয় একটি গন্তব্য হচ্ছে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। চলুন, দেশের প্রসিদ্ধ এই পর্যটন কেন্দ্রটি সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের অবস্থান

অভয়ারণ্যটির অবস্থান দেশের পূর্বাঞ্চলের বিভাগ সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে প্রায় ১৩০ কি.মি. দূরত্বে এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলটির অবস্থান। সুন্দরবনের পরেই এ শুকনো ও চিরহরিৎ বনটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি। একই সঙ্গে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবেও স্বীকৃত এই অঞ্চলটি।

ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন সমগ্র অভয়ারণ্যটির আয়তন ১ হাজার ৭ শ ৯৫ দশমিক ৫৪ হেক্টর। হবিগঞ্জ বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের রেমা,কালেঙ্গা ও ছনবাড়ী-এ তিনটি বিট পড়েছে অভয়ারণ্যের মধ্যে। অরণ্যের ভেতর দিয়ে ট্রেকিং পথে সিন্দুরখান ইউনিয়ন হয়ে পিচঢালা পথে শ্রীমঙ্গল পৌঁছা যায়।

ঢাকা থেকে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য যাওয়ার উপায়

ঢাকাবাসীদের সড়কপথে এ অভয়ারণ্যে যাওয়ার জন্য প্রথমে পৌঁছাতে হবে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। আরও একটু এগিয়ে শ্রীমঙ্গল হয়ে গেলে একসঙ্গে দুই অঞ্চলের পর্যটন স্থানগুলো ভ্রমণ করা যায়। ঢাকার সায়েদাবাদ বা গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি হবিগঞ্জের বাস আছে। এগুলোতে ভাড়া পড়বে ৪শ ৬০ টাকা এবং হবিগঞ্জের আগে শায়েস্তাগঞ্জে নেমে পড়তে হবে।

অপরদিকে শ্রীমঙ্গলের বাসে উঠলে খরচ হবে ৫শ ৭০ থেকে ৮শ টাকা। যারা ট্রেনে যেতে চান তাদেরকে উঠতে হবে সিলেটগামী ট্রেনে। এ ট্রেনগুলো শায়েস্তাগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উভয় জায়গাতেই থামে। সিটের ধরন ভেদে ভাড়া নিতে পারে ২৬৫ থেকে ১ হাজার ৯৯ টাকা।

আর সবচেয়ে দ্রুত যাওয়ার জন্য রয়েছে বিমান, যেখানে সিলেট পর্যন্ত যেতে খরচ হবে ৩ হাজার ৬শ থেকে ৪ হাজার ৮শ টাকা। সিলেট থেকে বাসে করে শায়েস্তাগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত আসতে হবে। দু জায়গা থেকেই সরাসরি কালেঙ্গা যাওয়ার অটোরিকশা বা জিপ গাড়ি পাওয়া যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে জিপে করে কালেঙ্গা যেতে খরচ পড়বে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ভ্রমণে কি কি দেখবেন

বনে প্রবেশ করতেই স্বাগত জানাবে মনোরম একটি লেক। পাশেই সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার,যেখান থেকে পুরো বনভূমি এক নজরে দেখে নেওয়া যায়।

এ অভয়ারণ্যে ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী,১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, এবং ১৬৭ প্রজাতির পাখি। পাখি প্রেমিদের জন্য এই অভয়ারণ্য সর্বোত্তম জায়গা। তবে একসঙ্গে অনেক পাখির দেখা পাওয়ার জন্য খুব ভোরে বনের ভেতর ঢুকতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ময়না, ভিমরাজ, কাও ধনেশ, ফোটা কান্টি সাতভারলা, শালিক, শ্যামা, শামুক খাওরি, ও টুনটুনিসহ আরও দুর্লভ প্রজাতির পাখি।

এখানকার প্রধান আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে শকুন দর্শন। বনভূমিটি শকুনের নিরাপদ অভয়ারণ্য হিসেবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। এ বনে ৩ প্রজাতির বানরের দেখা মেলে। এগুলো হলো- লাল বানর, নিশাচর লজ্জাবতী বানর, এবং উল্টোলেজি বানর। এ বনে কাঠবিড়ালী আছে ৫ প্রজাতির,যেগুলোর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালয়ান বড় কাঠবিড়ালি শুধুমাত্র এখানেই পাওয়া যায়। সাপের মধ্যে দেখা যায় দুধরাজ, কোবরা, দাঁড়াশ এবং লাউডগা।

এ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ট্রেকিং-এর জন্য রয়েছে ৩টি ট্রেইল। একটি আধ ঘন্টার,একটি ১ ঘন্টার, এবং একটি ৩ ঘন্টার পথ। এ পথে দেখা হয়ে যাবে আদিবাসীদের সাথে। এখানে মোট ৪ আদিবাসীর বসবাস- ত্রিপুরা,সাঁওতাল,উড়ং, এবং তেলুগু।

রেমা-কালেঙ্গা বনভূমি ভ্রমণের সেরা সময়

এ বনভূমিতে বৃষ্টির মৌসুম বাদে বছরের যে কোনও সময়েই ঘুরতে যাওয়া যায়। বর্ষায় ৩টি ট্রেইলের ২টিই চলাচলের একদম অযোগ্য হয়ে পড়ে। গরমে পাহাড়ি জংলা পথে অল্প হাটতেই ক্লান্তি চলে আসবে। তাই এ অভয়ারণ্য ভ্রমণের সেরা সময় হচ্ছে পুরোটা শীত এবং বসন্তের শুরু তথা ফাল্গুন মাস। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির যেকোনো দিন এখানে ঘুরে আসা যেতে পারে।

অভয়ারণ্য ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

এখানে বন বিভাগের বাংলো রয়েছে, তবে এখানে থাকতে সিলেট বন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া কয়েকটি বেসরকারি রিসোর্টও আছে। এগুলোতে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায় থাকা যেতে পারে। প্রতিবেলা খাবারের জন্য খরচ হতে পারে মাথাপিছু ২শ টাকা। হবিগঞ্জ শহরে কিছু মান সম্পন্ন আবাসিক হোটেল আছে, যেগুলোতে ভাড়া পড়বে ৮শ থেকে ২ হাজার ৫শ টাকা। বাহুবল উপজেলায় পাওয়া যাবে ৫ তারকা রিসোর্ট যেখানে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।

ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা

অভয়ারণ্য ভ্রমণে দিক নির্দেশনা ও থাকা-খাওয়া বন্দোবস্তের জন্য সঙ্গে অবশ্যই গাইড নেয়া আবশ্যক। ট্রেকিং-এর সময় সঙ্গে হালকা শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, এবং স্যালাইন রাখা জরুরি

জংলি জোঁক থেকে বাঁচতে পায়ে বড় মোজা পড়া যেতে পারে কিংবা সঙ্গে লবণ রাখা ভালো । বনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার্থে যেখানে সেখানে পলিথিন, খাবারের উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট, এবং পানির বোতল ফেলা যাবে না

হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে ট্রেইল তিনটির যেকোনো একটির ট্রেকিং-এ পাওয়া যাবে সারা জীবনের জন্য অমূল্য এক অভিজ্ঞতা। তাই শতভাগ উপভোগের জন্য পুরো ট্যুরের জন্য ন্যূনতম ২ দিন সময় নিয়ে যাওয়া উচিত।পাখিপ্রেমিদের জন্য রীতিমত স্বর্গরাজ্য বলা যেতে পারে এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলটিকে। এছাড়াও যত গহীনে প্রবেশ করা যাবে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ততই বিস্ময়ের খোরাক যোগাবে। উপরন্তু, স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোতে মিলবে প্রাচীন ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রার নিদর্শন। সব মিলিয়ে এ অভয়ারণ্য এক স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্রের আশ্রয়স্থল,যার সুরক্ষার দিকে দর্শনার্থীদেরও খেয়াল রাখা জরুরি। সূত্র : ইউএনবি

চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
২৬ অক্টোবর ২০২৪
এজি

Share