ফিচার

রূপে গুণে অনন্য এক উদ্ভিদ চাউর

রূপে গুণে অনন্য একটি গাছ হলো ‘চাউর’ গাছ। চাউর গাছ আবার চাউ গাছ নামেও কিছু কিছু অঞ্চলে পরিচিত। তাছাড়া এই গাছের পাতা মাছের লেজের মতো আকৃতির হওয়ায় একে Fishtail গাছও বলা হয়।

বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় এই গাছটি প্রচুর পাওয়া যায় এবং চাউ গাছ নামেই পরিচিত। চাউর গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Caryota urens। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে পাওয়া যায় এই চাউ গাছ।

চাউ গাছের বিচি থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। এটি পামজাতীয় গাছ। গাছটি সম্পূর্ণ বেড়ে উঠতে ৩-৪ বছর সময় লাগে। পূর্ণ বয়স্ক গাছে সাদা রঙের কুঁড়ি ধরে, কুঁড়ি থেকে কাঁদি কাঁদি ফুল ও ফুল থেকে ফল হয়। কুঁড়িগুলি মেয়েদের লম্বা চুলের বেণীর মতো ঝুলে থাকে। অসম্ভব সুন্দর এই কুঁড়ির বেণীগুলি যে কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

চাউর গাছ

প্রতিটি কাঁদিতে ২০-৩০টি বেণীর মতো হয়ে কুড়িগুলি ঝুলে থাকে। তাছাড়া পরিপক্ক একটি গাছের উচ্চতা ৩০-৪০ ফুট হওয়ায় সব গাছ ছাড়িয়ে তাল গাছের মতো বড় এই গাছটি সহজেই সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারে। প্রথমাবস্থায় কুঁড়িগুলো হালকা হলুদ রঙের হয় এবং পরবর্তীতে সবুজ থেকে সিঁদুর লাল রঙ ধারণ করে। তবে সব গাছে ফল ধরে না কেননা চাউয়ের ফুল একলিঙ্গ অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদা আলাদা গাছে জন্মে। কাছাকাছি বিপরীত লিঙ্গের কোনো গাছ না থাকলে পরাগমিলন হতে পারে না আর একবার পরাগমিলন হলেই ফুলগুলি ফলে পরিণত হয়। চাউ ফল পাকলে ফলটি দেখতে অনেকটা লটকনের মতো হয় তবে লটকনের বাইরের আবরণ যেমন নরম হয় চাউ ফলের বাইরের আবরণ তেমন নরম হয় না। লেঞ্জা নামের গেছো বিড়াল জাতীয় এক ধরণের প্রাণির চাউ ফল খুব পছন্দের খাবার। এরা চাউ ফল বিচিসহ গিলে ফেলে এবং পরবর্তীতে এদের মলের সাথে চাউয়ের বিচি বের হয়ে মাটিতে পরে এবং সেই বিচি থেকে আবার নতুন চাউ গাছ জন্মায়। তবে কষ্টের কথা হলো চাউ ফল পাকার পরপরই ভীষণ সুন্দর এই গাছটি মারা যায়। একবার ফল দিয়ে যেসব গাছ মারা যায় সেগুলিকে Monocarpic plant বলে। চাউ হলো সেই মনোকারপিক প্লান্ট। চাউ গাছে ফুল ধরলেই গাছ মারা যায় না, গাছটির ফুল যখন ফলে পরিণত হয় তখন গাছের মধ্যে যে রাসায়নিক পদার্থগুলি সৃষ্টি হয় সেগুলি বিভিন্ন হরমোনের কাজ করে যা গাছের পাতায় উৎপন্ন খাদ্যের সবটুকুই ফলের বৃদ্ধিতে জোগান দিয়ে চলে। ফলে গাছের অন্যান্য অংশ খাদ্যাভাবে ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ে ও অবশেষে গাছটি মারা যায়।

চাউ গাছের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। এই গাছের পাতা, ফল, কাণ্ড সবকিছুই কাজে লাগানো যায়। যেমন- চাউয়ের পাতাগুলি মসৃণ এবং মাছের লেজের মতো হওয়ায় এগুলি দিয়ে ঘরের ছাউনি দেয়া যায় ও ভালোমানের মেঝের ঝাড়ু, ঝুল ঝাড়ু ইত্যাদি তৈরি করা যায়। এই গাছের কান্ড বাঁশের মতো লম্বা হয় বলে ঘরের কাঠামো তৈরিতে বাঁশের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। গাছের মূল কান্ডের ভিতরের অংশ বাইরের মতো শক্ত না থাকায় সেই অংশটি ফেলে পানি সেচের একটি যন্ত্র তৈরি করা যায় যা নেত্রকোনা অঞ্চলে ‘কোন’ নামে পরিচিত। তাছাড়া চাউয়ের কান্ডকে মাচার ছাউনি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। চাউ ফল সুপারির পরিবর্তে খাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ফল পাকার আগে সবুজ অবস্থাতেই গাছ থেকে নামিয়ে কাঁদি থেকে চাউ ফলগুলি সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে পানিতে সিদ্ধ দিতে হয়। সিদ্ধ করার পর যে পানি পাওয়া যায় সে পানি খুবই ক্ষারযুক্ত থাকে এবং এই পানি মানুষের চামড়ায় লাগলে সেই স্থান খুব চুলকায়। তাই এই কাজটি করার সময় যথেষ্ট সাবধাণতা অবলম্বন করতে হয়। সিদ্ধ করা চাউ ফল কড়া রোদে শুকিয়ে নিয়ে এর চামড়া ছাড়িয়ে নিতে হয়। এক্ষেত্রে সিদ্ধ করা শুকনো চাউ ফলগুলিকে ঢেঁকিতে দিয়ে যেভাবে ঢেঁকি ছাঁটা চাল বের করা হয় তেমনি করলে চাউ ফলের উপরের আবরণ সরে গিয়ে সাদা আবরণ বের হয়ে আসে এবং তা সুপারির পরিবর্তে পানের সাথে চুন দিয়ে খাওয়া হয়। এই গাছের পাতা , কান্ড, কাঁদি জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। চাউ ফল থেকে গুড়, মদ ইত্যাদি তৈরি করা যায় তাই একে Wine palm, Jaggery palm নামেও ডাকা হয়।
বহুবিধ কাজে ব্যবহার উপযোগী এই গাছটির বাণিজ্যিক ব্যবহার নেই বললেই চলে। এর যথাযথ প্রতিপালন করে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশীয় পণ্য তৈরি করে চাহিদা মিটানো ও বিদেশেও এর রপ্তানি সম্ভব । এছাড়া সৌন্দর্য বর্ধনকারী বৃক্ষ হিসেবেও একে সমাদর করা যেতে পারে।

লেখক : মারুফা সুলতানা খান হীরামনি, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, পরিবেশ অধিদপ্তর, সদর দপ্তর, ঢাকা।

Share