খুলনার কিশোরী রাফিজা আক্তার। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তার ছবি ছাপা হয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি, ২০১৬ (আ ফেয়ার চান্স ফর এভরি চাইল্ড) প্রতিবেদনে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনের ছবিতে ডাস্টবিনের কাছে রাস্তার বাতির আলোয় রাফিজাকে পড়তে দেখা যায়। পাশেই তার ঘর। কিন্তু ঘরে বিদ্যুৎ নেই। তাই রাতে তাকে এভাবে পড়তে হয়।
মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে রাফিজার সঙ্গে কথা হয়। ওই দিনই ইউনিসেফের প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত হয়।
খুলনার ইসলামি মিশন রোডের রাফিজা এসেছিল ‘সব শিশুর জন্য সমান সুযোগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহায়তা করে ইউনিসেফ।
রাফিজা জানায়, ডাস্টবিনের কাছে রাস্তার বাতির আলোয় পড়তে তার ভয় লাগে। পড়ার সময় এলাকার বখাটেরা তাকে বিরক্তও করে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ করার পর এখন বখাটেদের উৎপাত কিছুটা কমেছে।
গোলটেবিল শুরুর আগে রাফিজা জানায়, প্রথমবার ঢাকায় এসেছে সে। ঢাকার বড়বড় দালানকোঠা দেখে তার বেশ অবাক লাগছে। আবার একধরনের ভালো লাগাও কাজ করছে।
রাফিজার কাছেই ইউনিসেফের প্রতিবেদনটি ছিল। লাজুক হেসে নিজেই তার ছবিটি দেখাল।
রাফিজা পড়ছে খুলনার নূরনগর মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয়ে। সে জানায়, দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে এ পর্যন্ত ক্লাসে তার রোল নম্বর ১। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনীতে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
জন্মের কয়েক দিনের মাথায় রাফিজার বাবা মারা যান। তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই সংসারে একটি মেয়ের জন্ম হয়। পরে সৎবাবা রাফিজাদের ফেলে চলে যান। এখন রাফিজা, তার সৎবোন ও তাদের মা একসঙ্গে থাকে।
রাফিজা জানায়, তার মা মানছুরা বেগম অসুস্থ। তিনি আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। অসুস্থতা নিয়েও মা দুটি দোকানে পানি বিক্রি করেন। অন্যের বাড়িতে থালাবাসন পরিষ্কার করেন।
রাফিজা জানায়, স্কুলে পড়ালেখা করতে তার বেতন লাগছে না। তবে প্রাইভেট পড়তে ৪০০ টাকা লাগে। এ ছাড়া আরেকজন শিক্ষক তাকে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি রাফিজা ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত মৈত্রী কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য। ক্লাবের সদস্য হিসেবে সে ইউনিসেফের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পায়। এর জন্যই সে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছে।
সহায়তার শর্ত হচ্ছে, রাফিজার মা তাকে বাল্যবিবাহ দিতে পারবেন না। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত স্কুলে ও ক্লাবে উপস্থিত থাকতে হবে। রাফিজাও কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না।
রাফিজার সঙ্গে ঢাকায় আসা কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সহায়িকা নাজমা পারভীন জানালেন, ছোট বয়স থেকে রাফিজাও কলসে করে পানি বিক্রি করত। পানিভর্তি বড় বড় কলসি বইতে তার কষ্ট হতো। একদিন তার মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়। সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর তিনি রাফিজাকে দিয়ে আর পানি বিক্রি না করাতে রাজি হন। এরপর রাফিজা ক্লাবের সদস্য হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে রাফিজা বলে, ‘আগে খাবার খেতে পেতাম না। পানি টানতে টানতে রাত হয়ে যেত। পরীক্ষার ফি দিতে হবে বলে সব সময় স্কুলে যেতাম না। এখন স্কুলে যাই। পড়ালেখা করি।’
নিজের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে রাফিজা বলে, ‘জীবনে একদিন উঠে দাঁড়াবই। মানুষের সেবা করতে চাই। এ জন্য চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখি।’