রাজনীতি

ব্যারিস্টার রাজ্জাকের ছায়া নেতৃত্বে জামায়াতের সংস্কারপন্থী এবি পার্টি

জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থীদের নতুন দল এবি পার্টি এখন দলটির কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে আইনজীবী আবদুর রাজ্জাককে ছায়া নেতৃত্বে রেখেই তাঁরা এগোচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে তিনি ছাড়াও জামায়াতের ভেতর–বাইরের আরও অনেকে নতুন দলে যুক্ত হবেন। এখন তাঁরা বাইরে থেকে পরামর্শ দিচ্ছেন।

২ মে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি)। এর উদ্যোক্তা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের একদল সংস্কারপন্থী নেতা-কর্মী, যাঁরা একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা না চাওয়া এবং দলটির বাস্তবভিত্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন।

কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতের বেশ কিছু সাবেক ও তরুণ নেতা-কর্মী এবি পার্টিতে যোগ দিতে আগ্রহী। এঁদের বেশির ভাগই রাজনীতির মাঠে স্বাধীনতা–বিরোধী বা রাজাকারের অপবাদ বয়ে বেড়াতে আর রাজি নন। তাঁরা এত দিন আশায় ছিলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় নেতাদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর জামায়াত দলে সংস্কার আনাসহ নতুন নামে দল গঠন করবে। জামায়াত ঘোষণা দিয়েও দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ওই অংশটি জামায়াত ছাড়ার জন্য উপযুক্ত সময়–সুযোগের অপেক্ষায় আছে। একপর্যায়ে আবদুর রাজ্জাকও নতুন দলের নেতৃত্বে আসবেন।

ব্যারিস্টার আাবদুর রাজ্জাক (ফাইল ছবি)

এ বিষয়ে এবি পার্টির নবনিযুক্ত আহ্বায়ক ও সাবেক সচিব এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী বলেন, ‘যখনই প্রয়োজন হয়, তখনই আমরা ওনার (আবদুর রাজ্জাক) পরামর্শ ও সহযোগিতা চাই। তিনি পরামর্শ দেন। সময়ই বলে দেবে, তিনি এবি পার্টির দায়িত্বশীল পদে আসবেন কি না।’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক এবি পার্টির নেতৃত্বে আসবেন। ওই পর্যন্ত তাঁর ছায়া নেতৃত্বে দল চলবে।

জামায়াতের অনেক তরুণ নেতা-কর্মী এ দলে যোগ দিতে আগ্রহী এঁরা আর স্বাধীনতাবিরোধীর অপবাদ বয়ে বেড়াতে চান না

অবশ্য এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‌‘আমি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে এ মুহূর্তে জড়িত নই।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৫০ বছর রাজনীতির ময়দানে আদর্শিক মেরুকরণ ও বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে দেশগড়ার কাজ হয়নি। এখন প্রয়োজন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। নতুন দল জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের এই আহ্বান গঠনমূলক রাজনীতির সূচনা করবে বলে তিনি মনে করেন।

দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত আবদুর রাজ্জাক গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে ইস্তফা দেন। পদত্যাগপত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জাতির কাছে জামায়াতের ক্ষমা না চাওয়া এবং বাস্তবতার আলোকে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে দলের সংস্কার আনতে ব্যর্থ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাক যুদ্ধাপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী ছিলেন। তাঁর পদত্যাগের পরদিনই জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হন দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। বহিষ্কৃত হওয়ার পর ২৭ এপ্রিল মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন নতুন দল গঠনের। এর প্রাথমিক উদ্যোগ ছিল জন আকাঙক্ষার বাংলাদেশ, যা এখন এবি পার্টি।

দলটির নেতারা জানান, আত্মপ্রকাশের পর গত এক সপ্তাহে সারা দেশে আড়াই হাজার ব্যক্তি অনলাইনে ও সরাসরি এবি পার্টির সদস্য ফরম পূরণ করেছেন। এরই মধ্যে দলে যোগ দিয়েছেন প্রয়াত আবদুল মতিনের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব বি এম নাজমুল হকসহ আরও কয়েকজন। বর্তমানে ৩৫টি জেলায় তাঁদের সাংগঠনিক কমিটি হয়েছে।

এবি পার্টির নেতৃস্থানীয় সূত্র জানায়, আপাতত তাঁরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো দলের রাজনৈতিক জোটে যাবেন না। তবে, যদি এবি পার্টির চিন্তা-চেতনার সঙ্গে খাপ খায় এবং কেড়ে নেওয়া নাগরিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দেয়, তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তাঁদের জোটবদ্ধ হতে আপত্তি থাকবে না।

অবশ্য দলটির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, বাস্তবে সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এর কারণ উল্লেখ করে ওই নেতা জানান, আত্মপ্রকাশের পর থেকে তাঁরা দ্বিমুখী আক্রমণ ও কটাক্ষের শিকার হচ্ছেন। এর একদিকে আছেন ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সমমনা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, অন্যদিকে আছে পুরোনো দল জামায়াত-শিবিরের লোকজন। যদিও নতুন দল গঠনের পর জামায়াত আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু তাঁরা লক্ষ করছেন, দলটির কর্মী-সমর্থকদের এক অংশ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করে চলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ও তাদের সহযোগীরা এবি পার্টিকে জামায়াতের ‘বি টিম’ বলে বক্তব্য দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির  বলেন, ‘আপনি যদি তাদের ইতিহাস লক্ষ করেন দেখবেন, যখনই জামায়াতে ইসলামী কোনো অসুবিধার মধ্যে পড়েছে, কোণঠাসা অবস্থার মধ্যে পড়েছে, তখনই তারা হয় গঠনতন্ত্র বদলেছে, নেতা পরিবর্তন করছে, এমনকি দলের নামও পরিবর্তন করেছে। এগুলো নতুন কিছু নয়। আমি বলি, এটা সাপের খোলস পাল্টানোর মতো।’

জামায়াতে ইসলামীর বাইরে ডান ও বাম ধারার একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরাও সন্দিহান যে আদতেই কি এবি পার্টি মৌলিকভাবে জামায়াতে ইসলামী থেকে পৃথক কোনো দল? নাকি জামায়াতেরই ছায়াবেষ্টিত সংগঠন?

তবে এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে এবি পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সময়ই বলবে আমরা কী। তবে গত কয়েক দিনে দেখছি, আমরা আওয়ামী লীগ এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ওই ঘরানার একটি গোষ্ঠীর পাশাপাশি জামায়াতের একটি অংশেরও তির্যক আক্রমণের শিকার হচ্ছি। বিশেষ করে, জামায়াত আমাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স মনে হচ্ছে। তারা হুমকি-ধমকিও দিচ্ছে।’

এ বিষয়ে জামায়াত ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, জামায়াত এ বিষয়ে একদমই চিন্তা করছে না।’ তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, যারা একটি ইসলামী দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল করল, তাদের ঘোষণাপত্রে ‘ইসলাম’ শব্দটি একটিবারও নেই। তাহলে কি তারা মূলত জামায়াত থেকে ইসলামেরই সংস্কার চেয়েছিল? (প্রথম আলো) আরো পড়ুন- নতুন রাজনৈতিক দল ‘এবি পার্টি’র আত্মপ্রকাশ

বার্তা কক্ষ, ১৪ মে ২০২০

Share